সহজ ও সঠিক মুলা চাষ পদ্ধতি ( ১২ মাসই চাষ করুন )

বাংলাদেশে বদলে যাচ্ছে কৃষিচিত্র, এখন বছরজুড়ে দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই মুলা চাষ হচ্ছে। এক সময় মৌসুমি সবজি হিসেবে মুলার চাষাবাদ হত শুধু শীতের সময়।

বর্তমান সময়ে বাজারে মুলার প্রচুর চাদিহা, তার পাশাপাশি ভালো দামও পাচ্ছে কৃষকরা। তাই, শত শত কৃষক এখন ১২ মাসই চাষে ঝুঁকছেন।

বীজ ঘর ডটকমের কৃষি কথা বিভাগে আমরা কৃষি ভিত্তিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকি। আজ আমারা এই নিবন্ধে আধুনিক মুলা চাষা পদ্ধতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আদ্যোপান্ত আলোচনা করব।

উন্নত মুলা চাষ পদ্ধতি

মুলা মুলত শীতকালীন সবজি। মুলার চাষাবাদের উপযোগি তাপমাত্রা ১০০-১২০ সে.। গ্রীষ্মে মুলার চাষ করলে ঝাঁঝালো ও ফলন কম হয়।

  • সুনিষ্কাশিত উঁচু, মাঝারি উঁচু ও মাঝারি নিচু জমি মূলা চাষের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট।

    উচ্চফলনশীল মুলা বীজ (হাইব্রিড)
    উচ্চফলনশীল মুলা বীজ (হাইব্রিড)
  • মূলা চাষের জন্য বেলে দো-আশ মাটি উপযুক্ত।
  • এছাড়া পলি দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিসহ সব ধরনের মাটিতে পরিমিত সার ও অন্যান্য উপাদান ব্যবহার করে লাভজনকভাবে মুলা চাষ করা যায়।
  • মূলা চাষের জমিতে ছাই ও জৈব সার ব্যবহারে মূলার ফলন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
  • মুলা ক্ষেতে পর্যাপ্ত রস থাকা বাঞ্ছনীয়।

বাংলাদেশে একসময় জাপানের বিখ্যাত তাসাকি সান জাতের উচ্চফলনশীল মূলার মাধ্যমে আবাদ শুরু হলেও এখন মূলার প্রায় ২৫টি জাত চাষ হচ্ছে। আসছে নিত্য নতুন স্বল্প জীবনকালের অধিক ফলনশীল হাইব্রিড জাত।

জমি তৈরি ও বীজ বপন পদ্ধতি

আশ্বিন থেকে কার্তিক মাসের মধ্যেই অধিকাংশ মূলার বীজ বপন করা হয়। মুলা চাষের জমি উপর্যুপরি চাষ দিয়ে মাটিকে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।

মুলা বীজ সরাসরি জমিতে বপন করা হয়। তাই জমি তৈরির ওপর মুলার ফলন অনেকাংশে নির্ভর করবে।

  • মুলা বীজ সারিতে বপন করাই উত্তম।
  • এজন্য উত্তমরূপে জমি তৈরির পর ৭৫ সেমি. প্রশস্থ ‘বেড’ তৈরি করতে হবে।
  • বেডের উভয় কিনারে ১৫ সেমি. ছেড়ে দিয়ে বেডের লম্বালম্বি ৪৫ সেমি. দূরত্বে দুটি লাইন টানতে হবে।
  • লাইন দুটি ১-২ সেমি. গভীর হতে হবে।
  • লাইনে ৩০ সেমি. দূরে দূরে ২-৩টি বীজ বোনা যেতে হবে।
  • বীজ বোনার সাথে সাথে দুইপাশের ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ভালোভাবে বীজ ঢেকে দিতে হবে।
  • দুই বেডের মাঝে ৩০ সেমি. চওড়া ও ১৫ সেমি. গভীর নালা থাকতে হবে।
  • বীজ বপনের পরপরই একবার সেচ দেয়া উত্তম।
  • বীজ বপনের ৭-১০ দিন পর অতিরিক্ত চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে।
  • ৩০ সেমি. দূরত্বে একটি করে চারা রাখা ভাল।

 প্রতি হেক্টরে বোনার জন্য ২.৫-৩.০ কেজি মুলা বীজের প্রয়োজন হয়। সাধারণত ছিটিয়ে মুলা বীজ রোপণ করা হয়। তবে সারিতে বোনলে পরিচর্যার সুবিধে হয়। সারিতে বুনতে হলে

সেচ ও পরিচর্যা

মুলার চাষাবাদে ভালো ফলন পেতে প্রয়োজন মতো সেচ দেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষেতে রসের অভাব হলে ১০ থেকে ১২ দিন পরপর ৩ থেকে ৪ বার সেচ দেওয়া উত্তম।

এছাড়া…

  •  আগাছা পরিষ্কার করে দিয়ে মুলা ক্ষেতের জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
  • মাটি শক্ত হয়ে গেলে নিড়ানী দিয়ে মাটির উপরের চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
  •  প্রচুর আলো বাতাস মুলার ফলন বৃদ্ধিতে সহায়ক।

অতিবৃষ্টির কারনে ক্ষেতে পানি বেশি জমে গেলে তাড়াতাড়ি পানি সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। জমির পানি বের করার জন্য নালা তৈরি ও মেরামত করে রাখুন ।

মুলার বেশি ফলন পেতে যেসব সার দিতে হবে

দেশে রবি মৌসুমের অন্যতম সবজি মুলা। সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করতে পারলে এই সবজির ভালো ফলন পাওয়া যায়।

যেভাবে সার প্রয়োগ করবেন…

  • মুলার জমিতে ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং বোরাক্স দিতে হয়।
  • মুলা ভালো ফলনের জন্য প্রতি হেক্টর জমির জন্য ৩৭৫ কেজি ইউরিয়া , টিএসপি ২২৫ কেজি, এমওপি ২২৫ কেজি, জিপসাম ১০০ কেজি এবং বোরাক্স ১০-১৫ কেজি প্রয়োজন হবে।
  • শেষ চাষের সময় টিএসপি, জিপসাম, বোরাক্স সবটুকু এবং ইউরিয়া ও এমওপি সারের অর্ধেক জমিতে দিতে হবে।
  • সারগুলো জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে মাটিতে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • বাকি ইউরিয়া ও এমওপি সার সমান দুই ভাগে ভাগ করে দুই কিস্তিতে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে।
  • এক্ষেত্রে প্রথম কিস্তি বীজ বপনের তিন সপ্তাহ পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি বীজ বপনের পাঁচ সপ্তাহ পর প্রয়োগ করতে হবে।
  • সকাল ও অথবা বিকেলের দিকে মুলা ক্ষেতে সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • প্রতি কিস্তি সার উপরি প্রয়োগের পর পরই সেচ দিতে হবে।

রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা

অল্টারনারিয়া পাতায় দাগ মুলার একটি সাধারণ সমস্যা। এছাড়া হোয়াইট স্পট বা সাদা দাগ রোগও দেখা যায। অনেক সময় বিট্‌ল বা ফ্লি বিট্‌ল মূলা পাতায় ছোট ছোট ছিদ্র করে ক্ষতি সাধন করে।

এ ছাড়া করাত মাছি বা মাস্টার্ড স’ ফ্লাই, বিছা পোকা ও ঘোড়া পোকা পাতা খায়। বীজ উৎপাদনের সময় ক্ষতি করে জাব পোকা।

  • ফ্লি বিটল পোকা দমনে কারটাপ জাতীয় কীটনাশক ১০-১২ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
  • জাব পোকা দমনে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক ১০-১২ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
  • মূলার বিছা পোকা দমনে এমামেক্টীন বেনজোয়েট জাতীয় কীটনাশক ১০ দিন পরপর ২ বার স্প্রে করতে হবে।
  •  মূলার পাতার দাগ রোগ দমনে কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক মিশিয়ে ১২-১৫দিন পরপর ২-৩বার ভালভাবে স্প্রে করতে হবে।
  • মুলার গ্রে মোল্ড রোগ দমনের জন্য কপারঅক্সিক্লোরাইট জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হবে।
  • মুলার মোজাইক রোগ দমনে জমিতে সাদা মাছি দেখা গেলে (বাহক পোকা) ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।

 কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের নির্দেশাবলি মেনে চলুন  বালাইনাশক বা কীটনাশক প্রয়োগ করা ক্ষেতের ফসল কমপক্ষে ৭ -১৫দিন পর বাজারজাত করতে হবে।

টবে বা ছাদ বাগানে মুলা চাষ পদ্ধতি

টবে বা ছাদে মুলা চাষের জন্য ইট দিয়ে তৈরী বেড হলে ভাল হয় । বেড না থাকলে বড় সিমেন্টের তৈরী টব বা হাফ ড্রামেও এর চাষ যায়।

এছাড়া…

  • ছাদ বাগানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সঠিকভাবে মাটি প্রস্তুত করা।
  • ২ ফুট বাই ২ ফুট টবের জন্য ২ ভাগ মাটির সাথে ১ ভাগ গোবর, ১০ গ্রাম টিএসপি এবং ১০ গ্রাম পটাশ সার মিশ্রিত করে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে ১২-১৫ দিন ।
  • মাটি কিছুটা শুকিয়ে এলে একটু ঝুরঝুরে করে তাতে মুলার বীজ বপন করতে হবে ।
  • চারা একটু বড় হলে অল্প অল্প পানি দিতে হবে ।
  • টবের মাটি ৭ দিন পর পর নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হবে ।
মুলার বীজ উৎপাদন
  • মুলা ক্ষেতের চারদিকে ১০০০ মিটারের মধ্যে অন্য কোন জাতের মুলার চাষাবাদ করা যাবে না।
  • জাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য এ পৃথকীকরণ দূরত্ব অপরিহার্য।
  • বীজ ফসলের জন্য অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বীজ বোনা ভালো।
  • মুলার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে জমি থেকে সমস্ত মুলা উঠিয়ে জাতের বিশুদ্ধতা, আকৃতি, রোগবালাই ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে মুলা বাছাই করতে হবে।
  • বাছাইকৃত মুলার মূলের এক-তৃতীয়াংশ এবং পাতার দুই-তৃতীয়াংশ কেটে ফেলতে হবে।
  • মূলের কাটা অংশ ডায়থেন এম-৪৫ (২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে) এর দ্রবণে ডুবিয়ে নিতে হবে।
  • পরে প্রস্তুত করা বেডে সারি পদ্ধতিতে ৪০ সেমি. x ৩০ সেমি. দূরত্বে মুলা গর্তে স্থাপন করে পাতার নিচ পর্যন্ত মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
  • এ পদ্ধতিতে পুনরায় রোপণকৃত গাছ থেকে অধিক পরিমাণে উন্নত মানের বীজ পাওয়া যায়।
  • বীজ-ফসলের জমিতে ১০-১৫ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে।
  • গাছে ফুল আসার পর হেক্টরপ্রতি অতিরিক্ত ১০০ কেজি ইউরিয়া ও ১০০ কেজি এমপি সার বেডে ছিটিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • প্রতিকূল আবহাওয়ায় বীজ-ফসল যাতে হেলে না পড়ে সেজন্য ঠেকনা দিতে হবে।

মুলার বীজ ফসলে জাবপোকা দেখা দেয়া মাত্র প্রিমোর-জোলন-ম্যালাথিয়ন কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২.০ মি.লি হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর প্রে করতে হবে।

অল্টারনারিয়া লিফ স্পট যদি মুলার পাতায় ও পডে (চড়ফ) দেখা দেয় তবে বীজ পরিপুষ্ট না হয়ে চিটা হয় এবং বীজের ফলন কমে যায়।

এর প্রতিকার হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম রোভরাল মিশিয়ে গাছে ১০-১২ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।

বীজ বপনের পর ৫-৬ মাসের মধ্যেই বীজ সংগ্রহের উপযুক্ত হয়।হেক্টরপ্রতি বীজের ফলন ১.৫-২.০ টন পর্যন্ত হতে পারে।

ফসল সংগ্রহ ও ফলন

মুলা বীজ বোনার ৪৫ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে মুলা উত্তোলন করে বাজারজাত করা যায়। এ সময় মুলা গড় ওজন ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি  হয়। জাতভেদে শতক প্রতি ফলন ২৫০-৩০০ কেজি।

সুত্র: লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00