সঠিক পদ্ধতিতে ফুলকপি চাষ, আগাম চাষে দ্বিগুণ লাভ!

শীতকালীন সবজি ফুলকপি চাষ এর সাথে তাপমাত্রার সম্পর্ক নিবিড়। ভালো ফলনে এই সবজির চাষাবাদের উপযোগী তাপমাত্রা হল ১৭ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ফুলকপি গাছের বৃদ্ধি থেকে শুরু করে বীজ ফুল আসা পর্যন্ত তাপমাত্রার ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। তবে, বর্তমানে শীতের সবজি ফুলকপির চাষাবাদ হচ্ছে গ্রীষ্মকালেও।

বীজ ঘর ডটকমের কৃষি কথা বিভাগে আমরা কৃষি ভিত্তিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকি। আজ আমারা এই নিবন্ধে ফুলকপির চাষাবাদের বিভিন্ন দিক নিয়ে আদ্যোপান্ত আলোচনা করব।

আধুনিক ও সঠিক ফুলকপি চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশ ফুলকপির পঞ্চাশের অধিক জাতে পাওয়া যায়। এর মধ্য থেকে শীতকালে আগাম, মধ্যম ও নাবী মৌসুমে এই সবজির চাষাবাদ হয়। এ ছাড়া গ্রীষ্মকালে চাষের উপযোগী জাতও আছে।

ফুলকপি চাষের আদর্শ সুনিকাশযুক্ত উর্বর দোআঁশ ও এটেল। তবে, খেয়াল রাখতে হবে চাষের নির্বাচিত জমিতে যেন সবসময় রোদ থাকে।

চারা তৈরি ও রোপণ পদ্ধতি

  • ফুলকপির চারা বীজতলায় উৎপাদন করে মূল জমিতে বপন করতে হয়।
  • বীজতলার আকার হবে পাশে ১ মিটার  ও লম্বায় ৩ মিটার।
  • বীজতলা সমপরিমাণ বালি, মাটি ও জৈবসার মিশিয়ে ঝুরাঝুরা করে তৈরি করতে হয়।
  • চারায় ৫-৬টি পাতা হলেই তা বপনের উপযুক্ত হয়।
  • সাধারণত ৩০-৩৫ দিন বয়সের চারা বোনা হয়।
  • এক সারি থেকে আরেক সারির দূরত্ব হতে হয় ৬০ সেন্টিমিটার বা ২ ফুট হবে।
  • এবং সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৪৫ সেন্টিমিটার বা দেড় ফুট।
  • চারা বপনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে শিকড় যেন মুচড়ে বা বাঁকা হয়ে না যায়, কারণ এতে চারার বৃদ্ধি কমে যেতে পারে।
  • চারা বপনের পর সেচ দিতে হবে।

ফুলকপির চারা ঠিকমত না বাড়লে প্রতি বীজতলায় ১০০ গ্রাম পরিমাণ ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে। ১ শতক জমিতে রোপণের জন্য ২- ২.৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে একরে ২০০- ২৫০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।

জমি তৈরি

ফুলকপির চাষাবাদের জমিতে ভালো ভাবে চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হয়।

গোবর সার, ছাই,কম্পোস্ট, খৈল ইত্যাদি সারের অর্ধেক পরিমাণ ভূমি জমি চাষের সময় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়।

হাইব্রিড ফুলকপি বীজ
হাইব্রিড ফুলকপি বীজ কিনুন 

মাটিতে যত বেশি জৈব পদার্থ থাকবে ততই ফুলকপির ফলন ভালো হবে। মাটির অম্লমান বা পিএইচ ৬.০-৬.৫ এ সবজির চাষাবাদের জন্য উত্তম।

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগের নিয়ম

ফুলকপির চাষাবাদে প্রতি বিঘায় ৩০ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টি এস পি , এমওপি ৩০ কেজি এবং ২ থেকে ৩ টন গোবর সার দিতে হবে।

যেভাবে প্রয়োগ করতে হবে…

  • চাষের জমি তৈরির সময় গোবর সার অর্ধেক, পুরো টিএসপি সার, অর্ধেক এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • বাকি অর্ধেক গোবর সার চারা বপনের এক সপ্তাহ আগে মাদায় দিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • ইউরিয়া এবং বাকি অর্ধেক এমওপি ও বোরন সার ৩ কিস্তি-তে প্রয়োগ করতে হবে।
  • সারের ১ম কিস্তি দিতে হবে চারা বপনের ৮-১০ দিন পর, ২য় কিস্তি সার দিতে হবে চারা বপনের ২৫ দিন পর এবং শেষ কিস্তির সময় সার দিতে হবে ৪০-৪৫ দিন পর।
  • সকালে শিশির ভেজা অবস্থায় কোন দানা সার দেওয়া যাবে না

এছাড়া…

  • জমি তৈরির সময়  পুরো বোরাক্স বা বোরন সার দেওয়া যাবে।
  • জমি তৈরির সময় দিতে না পারলে পরবর্তীতে প্রথম ও  দ্বিতীয় কিস্তিতে সার দেওয়ার সময় প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০-১৫ গ্রাম বোরিক পাউডার গুলে পাতায় স্প্রে করে দেওয়া যাবে।
  • সার প্ররয়োগের পর হালকা ভাবে মাটি কুপিয়ে সার ভালভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • সারির মাঝে সার দেয়ার পর সারির মাঝখানের মাটি দুপাশ থেকে তুলে গাছের গোড়ায় টেনে দিতে হবে।

সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা

প্রতিবার সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হবে। তবে, সেচ দেওয়ার পর ক্ষেতে পানি যেন বেশি সময় জমে না থাকে সেটা লক্ষ্য রাখতে হবে।

আগাছা ফুলকপি চাষের প্রধান শত্রু। তাই সার প্রয়োগের আগে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।

এছাড়া…

  • ফুলকপি র ক্ষেতে আগাছা থাকলে ফসলের বৃদ্ধি কমে যায়।
  • রোগ ও পোকা-মাকড়ের আক্রমন বেশী হয়ে থাকে।
  • যার জন্য ভাল ফলন থেকে বঞ্চিত হয়।
  • ক্ষেতে আগাছা দেখা দিলে তা  সাথে সাথে দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

ফুলকপির ফলন সাদা রাখার জন্য কচি অবস্থায় পাতা চারদিক থেকে টেনে বেঁধে ফুল ঢেকে দিতে হবে। সূর্যের আলো সরাসরি ফুলের উপর পড়লে ফসলের রং হলদেটে হয় বাজার দর কমে যাবে।

রোগ বালাই  ও পোকামাকড়  দমন ব্যবস্থাপনা

ফুলকপি চাষে সবচেয়ে ক্ষতিকর পোকা হল মাথা খেকো লেদা পোকা। এছাড়া পাতায় দাগ ও কালো পচা রোগ ফুলকপির চাষাবাদে অন্যতম সমস্যা।

বীজ উৎপাদনের জন্য চাষ করলে ফুলকপির ফুলকে জাব পোকার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অন্যান্য পোকার মধ্যে ক্রসোডলমিয়া কালো ও হলুদ বিছা পোকা, ঘোড়া পোকা ইত্যাদি মাঝে মাঝে ক্ষেতের ক্ষতি সাধন করে।

এছাড়া, বোরন সারের অভাবে ফুলে বাদামী দাগ পড়ে ও কান্ড ফাঁপা হয়ে যায়।

লেদা পোকা:

লেদা পোকা ফুলকপি গাছের কচি পাতা, ডগা ও পাতা খেয়ে নষ্ট করে। লেদা পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচতে …

  • পোকার ডিম ও লেদা পোকা হাত দিয়ে বাছাই করে নষ্ট করে ফেলতে হবে।
  • ফুলকপির ক্ষেত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে সব সময়।
  • এই পোকার আক্রমণ বেশি দেখা দিলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।

প্রতি লিটার পানিতে সাইপারমেথ্রিন( রিপকট/ কট/রেলোথ্রিন) ১ মিলি/ অথবা ক্যারাটে ১ মিলি/  মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

কাটুই পোকা

কাটুইপোকার কীড়া ফুলকপির চারা গাছের গোড়া কেটে দিয়ে থাকে। এই পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে…

  • জমিতে সন্ধ্যার পর বিষটোপ ব্যবহার করতে হবে।

অর্থাৎ ১ কেজি চালের কুঁড়া বা গমের ভূসির সাথে ২০ গ্রাম সেভিন নামক কীটনাশক পানি বা চিটাগুড়ের সাথে ব্যবহার কার যেতে পারে।

  • অথবা জমিতে চাষের সময় দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।

যেমন-ডায়াজিনন ২ কেজি প্রতি বিঘায় অথবা কার্বোফুরান ২ কেজি দিতে হবে। এছাড়াও ক্লোরপাইরিফস (ডার্সবান/ লর্সবান) ২ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

গোড়া পচা রোগ

এই রোগে আক্রান্ত ফুলকপির চারার গোড়ার চারদিকে পানিভেজা দাগ দেখা যায়। আক্রান্তের দুই দিনের মধ্যে চারা গাছটি ঢলে পড়ে।

শিকড় পচে যায়, চারা নেতিয়ে পড়ে গাছ মারা যায়।

রোগটি মাটিবাহিত বিধায় মাটি, আক্রান্ত চারা ও পানির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। এই রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচতে হলে…

  • পরিমিত সেচ ও পর্যাপ্ত জৈব সার প্রদান করা ও পানি নিস্কাশনের ভালো ব্যবস্থা রাখা।
  • সরিষার খৈল প্রতি বিঘায় ৪০ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে।

এছাড়া প্রতি লিটার পানিতে ইপ্রোডিয়ন বা কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় স্প্রে করতে হবে।

কার্ড বা মাথা পচা রোগ

ফুলকপির কার্ডে প্রথমে বাদামি রঙের গোলাকৃতি দাগ দেখা যায়। পরবর্তীতে একাধিক দাগ মিশে বড় দাগের সৃষ্টি করে।

ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে কার্ডে দ্রুত পচন ধরে নষ্ট হয়ে যায়।  আক্রান্ত কার্ড বা মাথা থেকে খুব কম পুষ্পমঞ্জরি বের হয়। ফলে এটি খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়। এই রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচতে …

  • সুস্থ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
  • বীজ বপনের আগে প্রোভ্যাক্স বা কার্বেনডাজিম বা নইন প্রতি কেজি বীজে ২ গ্রাম হারে দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।

ইপ্রোডিয়ন এবং কার্বেনডাজিম ছত্রাকনাশক প্রতিটি পৃথক পৃথকভাবে ০.২% হারে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর স্প্রে করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে,ওষুধ প্রয়োগের ৫ দিন পর পর্যন্ত ফসল তোলা যাবে না।

ফুলকপির আগাম জাতের চাষাবাদে লাভবান কৃষক –

আগাম জাতের ফুলকপি চাষের দিকে ঝুঁকছে কৃষকরা। কারণ ভরা মৌসুমে ভালো দাম না পেলেও অসময়ে ফুলকপি বিক্রি করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছেন তারা।

শীতকালে ফুলকপির ভরা মৌসুমে দাম একটু কম হলেও অন্য সময়ে বেশ ভালো দাম পাওয়া যায়।

তাই আগাম জাতের ফুলকপির দিকেই ঝুঁকছেন অনেক চাষি। বিক্রিরও তেমন ঝামেলা নেই, মাঠ থেকেই পাইকারি ক্রেতারা ক্রয় নিয়ে যায়।

পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ রঙিন ফুলকপি চাষ –
উচ্চফলনশীল ৫ কালার ফুলকপি বীজ (হাইব্রিড)
উচ্চফলনশীল ৫ কালার ফুলকপি বীজ (হাইব্রিড) কিনুন 

বাজারে সাদা ফুলকপি দেখেই অভ্যস্ত মানুষ। এখন সেই বাজারে স্থান করে নিচ্ছে রঙিন ফুলকপি।

রঙিন ফুলকপির পুষ্টির মান বেশ ভালো। এছাড়া এন্টি ব্যাকটেরিয়াল এবং ক্যান্সার বিরোধী পুষ্টি রয়েছে বলে জানান কৃষি কর্তারা।

রঙিন ফুলকপি সাদা ফুলকপির মতোই। দেখে মনে হয় সাদা ফুলকপির উপরে রঙ দেয়া হয়েছে।

বাজারে এই ফুলকপির দাম দ্বিগুণ। বাণিজ্যিকভাবে রঙিন ফুলকপির চাষ বাড়ানো হলে কৃষকরা আর্থিকভাবে আর বেশি লাভবান হবে বলে মনে করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

কারণ রঙিন ফুলকপির চাষাবাদে খরচের পরিমাণ একেই।

টবে বা ছাদ বাগানে ফুলকপি চাষের সহজ পদ্ধতি শিখে নিন –

সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে টবে বা  ছাদ বাগানে ফুলকপি চাষ করা যায় খুব সহজে। এবার তাহলে দেখে নেওয়া যাক টবে বা ছাদ বাগানে ফুলকপির চাষে কি কি করতে হবে…

  • ফুলকপি চাষের জন্য টব কিংবা জলের ড্রাম, অথবা সিমেন্টের বস্তা নিতে পারেন। বড় টব নিলে সব থেকে ভালো।
  • এই সবজি চাষের উপযুক্ত সময় হলো আগস্ট মাস থেকে সেপ্টেম্বর।
  • এই সময় চারা বপন করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
  • ফুলকপি চাষের জন্য বেলে-দোআঁশ মাটি খুব ভালো।
  • মাটি তৈরি করে তার মধ্যে বীজ বা চারা বপন করতে হবে এবং নিয়মিত পানি দিতে হবে।
  • নার্সারি থেকে সুস্থ সবল বীজ অথবা চারা আনতে পারেন।
  • তবে দুটি ক্ষেত্রেই মাটিটা খুবই উন্নত ধরণের দরকার।
  • ৫০% নিতে হবে নদী পারের মাটি, ৩০% ভারমি কম্পোস্ট (Vermi Compost) ও ২০% বালি মিশিয়ে মাটি তৈরী করতে পারেন।
  • নদী পারের মাটি যদি না পাওয়া যায় সেখানে তার পরিবর্তে কোকোপিট (Coco Peat) ও ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • ৫০ দিনের মাথায় এই গাছে ফুল চলে আসে। খুব ভালো ফলনের জন্য মাঝে মাঝে সর্ষে খোল পচিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

টবে বা ছাদ বাগানে ভালো ফলন পেতে ফুলকপির চাষে জৈব সার ব্যবহার করুন। গাছে পোকা মাকড়ের উৎপাত দেখা দিলে কীটনাশক স্প্রে করতে পারেন। গাছের পরিচর্যা করতে হবে নিয়মিত।

ফলন ও ফসল সংগ্রহ –

প্রতি একরে ১৫-২৫ টন, হেক্টরে ৩৫-৬০ টন ফুলকপির ফলন হয়। সাদা রঙ ও আঁটো সাঁটো আবস্থা থাকতেই ফসল তুলা উচিত। মাথা ঢিলা ও ফসলের রঙ হলদে ভাব ধারন করলে ফুলকপির দাম কম পাওয়া যাবে।

সুত্র: লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?