আধুনিক শিম চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশে শিম অত্যন্ত জনপ্রিয় শীতকালীন সবজি। জমি ছাড়াও রাস্তার ধারে, আইলে, ঘরের ছাদে এটির চাষ করা যায়।

এছাড়া সঠিক সময়ে বিজ্ঞান সম্মত আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করলে শিম চাষে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।

কারণ শিম গাছে অন্য সবজির মতো ভাইরাসের আক্রমণ নাই বললেই চলে; সার প্রয়োগেরও তেমন প্রয়োজন পড়ে না।

যেভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে শিম চাষ করবেন

শিমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ কৃষকরা ব্যপক লাভবান হওয়ায়, গ্রীষ্মকালীন বা আগাম শিম চাষে ঝুঁকছেন অনেক কৃষক।

তবে শিম চাষের সাঠিক পদ্ধতি জানা না থাকার কারণে অনেকেই কাঙ্ক্ষিত সফলতা পাচ্ছে না। তাই, আসুন জেনে নিই যেভাবে শিমের চাষাবাদে সফলতা আসে…

মাটি ও বীজ বপনের সময়

উচ্চফলনশীল নলডগ শিম বীজ
উচ্চফলনশীল নলডগ শিম বীজ কিনুন

শিমের আগাম চাষের জন্য জৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় আর শীতকালীন চাষাবাদের শ্রাবণ থেকে ভাদ্র মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।

সব ধরণের মাটিতে শিম জন্মে ৷ তবে, সুনিকাশযুক্ত দোআশ ও বেলে দোআশ মাটিতে শিমের ভালো ফলন পাওয়া যায়। ঠান্ডাও শুষ্ক আবহাওয়ায় শিমের ফলন ভালো হয় ৷

জমি নির্বাচন ও মাদা তৈরি

শিমের বাণিজ্যিক চাষাবাদে ক্ষেত্রে জমি বেশ কয়েকবার ভালোভাবে চাষ ও মই দিতে হবে। এরপর মাদার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতার আকার ৪৫ সেন্টিমিটার রাখতে হবে। এক মাদা থেকে অন্য মাদার দূরত্ব হবে ৩.০ মিটার।

এছাড়া……

  • সিম গাছ জলাবদ্ধতা সহনশীল নয়।
  • তাই উচু জমি নির্বাচন করতে হবে।
  • জমিতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকতে হবে।

মাদায় সার প্রয়োগ

বাণিজ্যিকভাবে শিমের চাষাবাদে সার প্রয়োগের বিকল্প নেই।

প্রতি মাদার জন্য গোবর ১০ কেজি, খৈল ২০০ গ্রাম,ছাই ২ কেজি, টিএসপি ১০০ গ্রাম, এমওপি ৫০ গ্রাম।

মাদা তৈরির সময় এ সার প্রয়োগ করতে হবে।

এছাড়া…

  • চারা গজালে ১৪-২১ দিন পর পর দু’কিস্তিতে ৫০ গ্রাম করে ইউরিয়া, ও ৫০ গ্রাম করে এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • ফলন সংগ্রহের পর বা গাছের অবস্থা বুঝে পরিমাণ মতো ইউরিয়া, পটাশ, ডিএপি, জিংক, বোরন ইত্যাদি সার দিতে হবে।
  • হরমন হিসেবে ফ্লোরা, লিটোসেন ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
বীজ বপন ও মাচা
উচ্চফলনশীল কামরাঙ্গা শিম বীজ
উচ্চফলনশীল কামরাঙ্গা শিম বীজ কিনুন
  • প্রতি মাদায় ৪-৫ টি বীজ বুনতে হয়।
  • বীজ বোনার আগে ১০-১২ ঘন্টা বীজ ভিজিয়ে নিতে হবে।
  • বীজ গজানোর পর প্রতিটি মাদায় ২-৩টি করে সুস্থ চারা রেখে বাকি গুলো তুলে ফেলতে হবে।
  • বীজ বোনার সময় বর্ষা থাকলে মাদায় যাতে পানি না জমে সে জন্য মাদার ভরাট মাটি ৫ সেমি পরিমাণ উঁচু রাখতে হয়।
  • জমিতে লাইন করে বীজ বপন করলে ৩০ সেমি দূরত্বের সারিতে ১৫ সেমি দূরে দূরে বীজ লাগাতে হয়৷

এছাড়া…

শিমগাছ লতা নিতে শুরু করলে মাচার ব্যবস্থা করতে হবে। গাছ যখন ১৫-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হবে; তখন বাউনির ব্যবস্থা করতে হবে। শিম গাছ লতা নেওয়ার সুযোগ যত বেশি পায়, ফলন তত বেশি হয়।

বীজের হার: প্রতি শতকে ৪০ গ্রাম, একরপ্রতি ৪ কেজি, হেক্টরপ্রতি ১০ কেজি।

পরিচর্যা

শিম গাছের গোড়ায় কোন অবস্থাতেই পানি যেন না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মিত শিম গাছের গোড়া ও তার আশপাশের আগাছা নিড়ানি দিয়ে নিয়মিত আলগা এবং পরিষ্কার করে দিতে হবে।

এছাড়…

  • শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হবে।
  • গাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • গাছ যখন ১৫-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হবে তখন মাদার গাছের গোড়ার পাশে বাঁশের ডগা মাটিতে পুঁতে বাউনির ব্যবস্থা করতে হবে।
  • শিমের খরা সহ্য করার ক্ষ্মতা থাকলেও পানির অভাবে মাটিতে রসের ঘাটতি হলে সেচ দিতে হবে।
  • শিম গাছ খুব বেশী বাড়তি হয়ে গেলে শাখা প্রশাখার আগা ভেঙে দিতে হবে৷

জাত নির্বাচন: গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন শিমের জাত সমুহ

আমাদের দেশে পঞ্চাশটিরও বেশি স্থানীয় শিমের জাত আছে।

উচ্চফলনশীল ইপসা শিম বীজ
উচ্চফলনশীল ইপসা শিম বীজ কিনুন 

এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বাইনতারা, হাতিকান, চ্যাপ্টাশিম, ধলা শিম, পুটিশিম, ঘৃত কাঞ্চন, সীতাকুন্ডু, নলডক ইত্যাদি।

বারি শিম ১, বারি শিম ২, বিইউ শিম ৩, ইপসা শিম ১, ইপসা শিম ২, একস্ট্রা আর্লি, আইরেট ইত্যাদি আধুনিক উচ্চ ফলনশীল জাত।

গ্রীষ্মকালীন শিমের জন্য অটো শিম খুব উপযুক্ত। এটি বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাসে বপন করলে শ্রাবণ মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত বিরামহীন ফলন দিতে থাকে।

এছাড়াও আইরেট, ইপসা-১ ও ২, বিইউ শিম-৪, বারি শিম- ৩ ও ৭ সহ আরো কিছু জাত আছে।

আগাম চাষের জন্য পুটি শিম অথবা গ্রীষ্মকালীন জাতগুলোই ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া মাঝারি আগাম জাত হিসেবে বিইউ শিম-৩ আগস্ট মাস থেকেই বপন শুরু করা যায়।

শীতকালীন জাতের মধ্যে বারি শিম-১ হচ্ছে নাম্বার ওয়ান। এছাড়াও বারি শিম-৬, নলডগ, হাতিকান, গোলগাদ্দা সহ আরো বহু ধরনের শিমের জাত আছে।

নিচে কয়েকটি আধুনিক জাতের শিমের পরিচয় দেয়া হল-

  • বারি শিম ১: মাঝারি আগাম জাত। আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাসে বীজ বপন করতে হয়।
  • বারি শিম ২: আগাম জাত। আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাসে বীজ বপন করতে হয়।
  • বিইউ শিম ৩: সারা বছর চাষ করা যায়। গ্রীষ্ম মৌসুমেও চাষের উপযোগী। শিমের রঙ বেগুনি।
  • ইপসা শিম ১: সারা বছর চাষ করা যায়। গ্রীষ্ম মৌসুমেও চাষের উপযোগী। শিমের রঙ বেগুনি।
  • ইপসা শিম ২: সারা বছর চাষ করা যায়। গ্রীষ্ম মৌসুমেও চাষের উপযোগী। শিমের রঙ সাদাটে সবুজ।

রোগ-বালাই

শিমের সবচেয়ে মারাত্মক রোগ মোজেইক ও অ্যানথ্রাকনোজ। এছাড়া চারা অবস্থায় পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা ক্ষতিকর।

  • শিমের সবচেয়ে মারাত্মক রোগ মোজেইক ও অ্যানথ্রাকনোজ।
  • এছাড়া চারা অবস্থায় পাতা সুড়ঙ্গকারী পোকা ক্ষতিকর।
  • লাল ক্ষুদ্র মাকড়ও অনেক সময় বেশ ক্ষতি করে থাকে।
  • ফুল ফুটলে থ্রিপস ক্ষতি করতে পারে।
  • ফল পেকে এলে শিমের গান্ধি পোকা ক্ষতি করে।

আইপিএম পদ্ধতি অনুসরণ করে এসব পোকামাকড় দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে অথবা কৃষিবিদদের পরামর্শ নিয়ে সহনীয় মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

এছাড়..

  • জাব পোকা আর সাদা মাছির জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড গ্রুপের কীটনাষক স্প্রে করতে পারেন।
  • আর ফলছিদ্রকারী পোকার জন্য এমামেকটিন বেনজয়েড গ্রুপের কীটনাষক অথবা সাইপারমেথ্রিন স্প্রে করতে পারেন।
  • শীতকালীন শিমে বালাইনাষক কম দেয়া লাগে। তাই শীতকালীন শিম চাষে খরচ কম হয়।
ছাদে সহজে শিম চাষ পদ্ধতি
উচ্চফলনশীল রূপবান শিম বীজ
উচ্চফলনশীল রূপবান শিম বীজ কিনুন

আমাদের দেশে সাধারণত যে ভাবে শিমের চাষাবাদ হয়, তাতে অনেক জায়গার প্রয়োজন। তবে ছাদ বাগানে খুব অল্প জায়গায়তে শিমের চাষাবাদ করা সম্ভব।

ছাদ বাগানে শিমের চাষাবাদের সঠিক নিয়মাবলি জেনে নিন…

  • ছাদ বাগানে শিমের চাষাবাদের জন্য একটি টবই যথেষ্ট।
  • টবের জন্য মাত্র ২ বর্গফুট জায়গার প্রয়োজন হবে।
  • প্রথমে টবে জৈব সারযুক্ত মাটি দিয়ে ভরাট করতে হবে।
  • এরপর বীজ বোনতে হবে।
  • বীজ বপনের পর হালকা পানি ছিটিয়ে দিতে হবে।
  • চারা গজানোর পরে টবের কিনারায় ৪-৫ ফুট লম্বা কয়েকটি খুঁটি পুঁতে দিতে হবে।
  • খুঁটির মাথাগুলো ১.৫ থেকে ২.০ ফুট কাঠি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে।
  • এরপর ফ্রেমের নিচে থেকে উপরে সুতা অথবা রশি দিয়ে মুড়িয়ে দিতে হবে।
  • তারপর গাছ ৪-৫ ফুট লম্বা হলে ডগা কেটে দিতে হবে।

কোনো ভাবেই গাছকে ফ্রেমের বাইরে যেতে দেওয়াই ভাল। গবেষণায় দেখেগেছে মাত্র ১৫-২০ কেজি মাটি হলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়। একটি টবে মাত্র দুটো গাছ থাকবে।

ফসল সংগ্রহ

বীজ বপনের ৪৫ থেকে ৫০ দিন মধ্যে শিম গাছে ফুল আসে। ফুল ফোটার ২০-২৫ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়। ৪ মাসেরও বেশী সময় ধরে শিম গাছে ফলন পাওয়া যায়।

কচি অবস্থায় শিম সংগ্রহ করতে হবে৷ মনে রাখতে হবে যে ক্ষেতে রাসয়নিক ঔষধ প্রয়োগের অন্তত সাত দিন পর্যন্ত ঐ ক্ষেতের শিম বিক্রি বা খাওয়া যাবে না।

সুত্র: লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?