কৃষি কথা

আধুনিক পেঁয়াজ চাষ পদ্ধতি জেনে নিন

যেভাবে পেঁয়াজ চাষ করবেন

ইদানিং ব্যাপকভাবে অর্থকরী ফসল পেঁয়াজ চাষ আমাদের দেশে। এখন শুধু শীতকাল না বর্ষাকালেও পেঁয়াজের চাষাবাদ হচ্ছে।

আজ আমরা পেঁয়াজ চাষের নিয়ম ও কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এই নিবন্ধে।

যেভাবে পেঁয়াজ চাষ করবেন

মাটি– দোআঁশ ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা দোআঁশ বা পলিযুক্ত মাটি পেঁয়াজ চাষের জন্য উত্তম। মাটি উর্বর এবং সেচ ও নিষ্কাশন সুবিধাযুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আবহাওয়া – প্রচুর দিনের আলো, সহনশীল তাপমাত্রা ও মাটিতে প্রয়োজনীয় রস থাকলে পেঁয়াজের ফলন খুব ভাল হয়।

রবি/শীতকালীন পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ১৫-২৫° সে. তাপমাত্রা পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য উপযোগী।

ছোট অবস্থায় যখন শেকড় ও পাতা বাড়তে থাকে তখন ১৫° সে. তাপমাত্রায় ৯-১০ ঘন্টা দিনের আলো থাকলে পেঁয়াজের বাল্ব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং পরবর্তীতে ১০-১২ ঘন্টা দিনের আলা ও ২১° সে. তাপমাত্রা এবং গড় আর্দ্রতা ৭০ শতাংশ থাকলে পেঁয়াজের কন্দ ভালভাবে বাড়ে, বীজ গঠিত হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়।

মাটির পিএইচ ৫.৮ থেকে ৬.৫ হলে পেঁয়াজের ফলন ভাল হয়। হালকা মাটিতে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগে পেঁয়াজের ফলণ ভাল হয়। অধিক ক্ষার বা অম্ল মাটিতে পেঁয়াজের আকার ছোট হয় ও পুষ্ট হতে বেশী সময় লাগে।

বীজ হার: ৩৩ শতক বা ১ বিঘাতে হাইব্রিড বীজ ৬০০-৭০০ গ্রাম আর তাহেরপুরী বা ক্রস জাত ৮০০ গ্রাম লাগে চারা করে চাষ করলে আর যদি ছিটিয়ে বোনা হয় ১.৫ – ২ কেজি বীজ লাগবে।

তবে ভাল ফলনের জন্য চারা করা উত্তম।

বীজ বপনের সময়: অক্টোবর- নভেম্বর পর্যন্ত বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। বীজতলা শোধন: বীজ বপনের আগে বীজতলা শোধন করে নেয়া উচিৎ।

প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম হারে বায়োডার্মা পাউডার দিয়ে বীজতলা শোধন করে নেয়া উচিত অথবা বীজতলার উপর ২-৩ ইঞ্চি পুরু করে খড় বিছিয়ে আগুন জ্বালিয়ে বীজতলা শোধন করা যেতে পারে।

বীজ শোধন:  প্রতি কেজি বীজের সাথে ২ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম বা প্রোভ্যাক্স মিশিয়ে বীজ শোধন করা যায়।

বীজতলায় সার প্রয়োগ: প্রতিটি বীজতলায় টিএসপি, এমওপি ও দানা জাতীয় কীটনাশক পরিমান মত দিয়ে বীজ তলা তৈরী করতে হবে।

বীজ বপন পদ্ধতি: দৈর্ঘ্য ১০ ফুট প্রস্থ ৩ ফুট আকারের প্রতিটি বীজতলায় ২৫-৩০ গ্রাম অথবা প্রতি বিঘায় ৭০০-১০০০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হবে।

বোনার পর ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ১ সেমি. পুরু করে ঢেকে দিতে হয়।

বীজ বোনার পর হালকা সেচ দিয়ে বীজতলা ভালভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে এবং তারপর প্রয়োজন অনুসারে ১-২ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে।

বোনার প্রায় ৫-৭ দিন পর বীজ অংকুরিত হয়ে চারা বের হবে।

চারার বয়স: বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর united চারা যখন ৬-৭ ইঞ্চি লম্বা হয় তখন জমিতে রোপণ করতে হবে।

পেঁয়াজ চাষে বিঘা প্রতি ৩৩ শতকে সারের পরিমান

সারের পরিমাণ

  • গোবর ১২০০ কেজি ( মাটি ভেদে কম বেশি হতে পারে),
  • ইউরিয়া ২০ কেজি, টিএসপি ৩০ কেজি,
  • এমওপি ২০ কেজি, জিপসাম ২৫ কেজি,
  • জিংক ১ কেজি (আলাদাভাবে),
  • বোরন ১ কেজি, ফিপ্রোনিল ৩ জি আর (দানা কীটনাশক)- ৩-৪ কেজি,
  • বোরন ১৭℅ – ৫০০ গ্রাম।

সার প্রয়োগ পদ্ধতি: শেষ চাষের সময় সবটুকু গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিংক বোরন এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপির সার জমিতে সমানভাবে ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।

বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ও এমওপি সার যথাক্রমে চারা রোপণের ২৫ এবং ৫০ দিন পর ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।

কন্দ বা সরাসরি বীজ বপন করে চাষ করার ক্ষেত্রেও মোটামুটিভাবে একই নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।

জমি তৈরি: পেয়াজের জমি ৩-৪ টি চাষ দিতে হবে। জমি আগাছামুক্ত করে বীজ বপন/চারা রোপন/কন্দ রোপন করতে হবে।

চারা রোপণ পদ্ধতি: ছিটানো পদ্ধতি।  কন্দ রোপন।  চারা রোপন।

কন্দ ও চারা জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬ ইঞ্চি এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৪ ইঞ্চি রাখতে হবে।

কন্দ রোপন: প্রতি কেজিতে ৬০-৭৫ টি পেঁয়াজ ধরে এমন পেঁয়াজ রোপণ করতে হবে।

সেচ প্রয়োগ:  পেঁয়াজের জমিতে মাটির প্রয়োজনীয় রস না থাকলে প্রতি ১০-১৫ দিন অন্তর পানি সেচ প্রয়োজন।

অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা: পেঁয়াজের কন্দ উৎপাদনের ক্ষেত্রে ফুলের কলি দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই তা ভেঙ্গে দিতে হবে।

পানি নিষ্কাশন: পেঁয়াজ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। পেঁয়াজের জমিতে পানি নিকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

আগাছা:  পেয়াজের জমিতে প্রচুর আগাছা হয়ে থাকে তাই জমি আগাছামুক্ত রাখতে হবে। সেচের পর জমি নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হবে।

পোকা:  পেঁয়াজের ক্ষতিকর পোকা হল

  • কাটুইপোকা- ডারসবান,ক্যারাটে, ফাইটার নাইট্রো/সেতারা/ক্লোরোসাইরিন/এসিমিক্স যে কোন একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ৩ মিলি হারে মিশিয়ে সন্ধ্যার পর স্প্রে করতে পারেন।
  • থ্রিপস- এডমায়ার, /ইমিটাফ/ইমপেল/জাদিদ/তুন্দা/ কনফিডর/ট্রেসার যে কোন একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে পারেন।
  • ফিড ও মাইট মাকড়– ভার্টিমেক/টক্সিমাইট/সানমেক্টিন, একামাইট যে কোন একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ১.২৫ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে পারেন।
  • ঘোড়াপোকা-রিপকর্ড/রীভা/লিমপার/সাইপেরিন/কর্ট/রেলোথ্রিন যে কোন একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ০.৫০ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে পারেন।
রোগ সমূহ
  • পার্পল ব্লচ- রোভরাল/রোভানন/হেপ্রোডিয়ন যে কোন একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে পারেন।
  • কন্দ পচা -টিল্ট/প্রোটেন্ট/প্রাউড/রোভরাল যে কোন একটি কীটনাশক স্প্রে করতে পারেন।
  • গোড়া পচা- বায়োডার্মা পাউডার প্রতি লিটার পানিতে ৩ গ্রাম হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে পারেন।
  • হোয়াইট রট – রোভরাল/জিবাল যে কোন একটি বালাইনাশক স্প্রে করতে পারেন।
পেঁয়াজ সংগ্রহ

পেঁয়াজ পরিপক্ক হলে পাতা ক্রমশ হলদে হয়ে যায় এবং পাতার অগ্রভাগ শুকিয়ে নুইয়ে পড়ে।

যখন ৭০-৮০% পাতার অগ্রভাগ শুকিয়ে নেতিয়ে পড়ে তখনই পেঁয়াজ তোলার উপযুক্ত সময়।

সাধারণত রোপনের ৯০ থেকে ১১০ দিনের মধ্যে শীতকালিন পেঁয়াজ তোলার উপযুক্ত হয়।

সতকর্তা: পেঁয়াজ পরিপক্ক হয়ে গেলে কোন কারনে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে কিছুদিন পর পেঁয়াজ সংগ্রহ করতে হবে না হলে উত্তোলিত পেয়াঁজ সংরক্ষণ করা যাবেনা।

ফলন
  •  তাহেরপুরী (৪৫-৫০মণ)
  • হাইব্রিড জাত ( ১৫০-১৮০ মণ) বিঘা প্রতি।

পেঁয়াজ সংরক্ষন

ভালভাবে পরিপক্কতার পর উজ্জ্বল রৌদ্রযুক্ত দিনে পেঁয়াজ সংগ্রহ করে, পাতা ও শিকড় কেটে ৫-৭ দিন বায়ু চলাচলে সুবিধাযুক্ত হালকা ঠান্ডা ও ছায়াযুক্ত স্হানে শুকিয়ে নিতে হয় এবং টিনের ঘরে মাচায় করে মাচায় সংরক্ষণ করতে হয়।

লক্ষ্য রাখতে হবে যেন পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা ঘরে পর্যাপ্ত আলো – বাতাস প্রবেশ করতে পারে এবং মাঝে দেখতে হবে পচা পেঁয়াজে বাছাই করে ফেলে দিতে হবে।

বা ভাল কন্দগুলো যথাযথভাবে বাছাই করে শুষ্ক, ঠান্ডা ও বায়ু চলাচলের উপযুক্ত জায়গায় বাঁশের মাচা তৈরি করে ৭-৮ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।

এ ছাড়া ঘরের সিলিং প্লাষ্টিক বা বাঁশের র‍্যাক অথবা ঘরের পাকা মেঝেতে রেখে সংরক্ষণ করা যায়।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *