সূর্যমুখী ফুল চাষ, জেনে নিন সঠিক ও সহজ পদ্ধতি

সূর্যমুখী ফুল চাষ লাভজনক। এদেশের মাটি ও আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় কৃষিজমির পাশাপাশি পতিত জমিতে এই ফুল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে চাষিরা।

সূর্যমুখী শুধু ফুলই নয়, এটি অর্থকরী ফসলও বটে। উৎপাদন খরচ কম, এছাড়া ফুল থেকে উৎপাদিত তেল ও খৈল বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হাচ্ছে কৃষকরা।

আজ আমরা এই নিবন্ধে সূর্যমুখী ফুল চাষের পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ।

সূর্যমুখী ফুল চাষ, শিখে নিন সঠিক নিয়ম

সব ধরণের মাটিতে সূর্যমুখী ফুল চাষ করা গেলেও মাঝারি নিচু দো-আঁশ মাটির জমি সবচেয়ে বেশী উপযোগী। অত্যন্ত নিচু জমি বা যেখানে পানি জমে থাকে, এমন জমিতে এই ফুলের চাষাবাদ করা একদম অনুচিত।

উচ্চফলনশীল সূর্যমুখী ফুল বীজ (হাইব্রিড)
উচ্চফলনশীল সূর্যমুখী ফুল বীজ (হাইব্রিড)
  • এছাড়া লবণাক্ত জমিতে সূর্যমুখী ফুলের গাছ ভালো জন্মে।
  • বছর জুডে এই ফুলের চাষাবাদ করা যায়। তবে বেশ কয়েকটি বিষয় মেনে চলতে হবে।
  • রবি মৌসুমে অগ্রহায়ন ( নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরে) মাস চাষাবাদ শুরু করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
  • তাপমাত্রা ১৫ সেন্টিগ্রেড এর নিচে হলে বীজ বোনা থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • খরিপ-১ মৌসুমে জ্যৈষ্ঠে (মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে) মাসেও সূর্যমুখীর চাষাবাদ করা যাবে।
  • খরিপ ২ মৌসুমে চাষের জন্য ভাদ্র (আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর) মাসে বীজ বপন করতে হবে।

জমি তৈরি ও বীজ বপন

সূর্যমুখী ফুল গভীরমূলী ফসল। তাই এই ফুল চাষাবাদের জমি ৩-৪ বার ভালোভাবে চাষ দেওয়ার পরে মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে সমান করতে হবে।

  • এরপর জমি ছোট ছোট প্লটে ভাগ করে নিলে বীজ বোনার পর পরিচর্যা করতে সুবিধে হয়।
  • সূর্যমুখী বীজ সারিতে বোনলে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৫০ সেন্টিমিটার।
  • এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব হতে হবে ২৫ সেন্টিমিটার।
  • প্রতিটি স্থানে ২-৩ করে বীজ বোনতে হবে ২-৩ সেন্টিমিটার গভীরে।
  • চারা গজানোর পর সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে।
  • বপনের আগে বীজ শোধন খুব জরুরি; এছাড়া বীজ ৬-৭ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
  • এতে বীজের ত্বক নরম হবে, অঙ্কুরোদগম ভালো হবে।
  • সূর্যমুখী ফুলের চারা গজানোর পর কিছুদিন ঠাণ্ডা আবহাওয়া প্রয়োজন।
  • এছাড় এই ফুলের দৈহিক বৃদ্ধির সময় হালকা বৃষ্টিপাত হলে ভালো।
  • এরপর পুষ্পায়নের জন্য কিছুটা উষ্ণ আবহাওয়া দরকার।
  • এছাড়া ভালো ফলনের জন্য বীজ পাকার সময় মেঘমুক্ত আকাশ খুবই উপযোগী।

সার প্রয়োগ

ভালো ফলন পেতে হলে সূর্যমুখী চাষের জমিতে পরিমিত মাত্রায় সার দিতে হবে। জৈবসার সহ অন্যান্য সব ধরনের সারই প্রয়োজন অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে।

জৈব সার দিলে মাটির গুনাগুন ভালো থাকবে। এছাড়া হেক্টর প্রতি …

  • ইউরিয়া ১৮০-২০০ কেজি
  • টিএসপি ১৫০-২০০ কেজি
  • এমওপি ১২০-১৫০ কেজি
  • জিপসাম ১২০-১৭০ কেজি
  • জিংক সালফেট ৮-১০ কেজি
  • বরিক এসিড ১০-১২ কেজি
  • ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৮০-১০০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।

শেষ চাষের সময় অর্ধেক ইউরিয়া অন্যান্য সব সার জমিতে প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। অবশিষ্ট অর্ধেক ইউরিয়া সমান ২ কিস্তিতে প্রথমভাগ চারা গজানোর ২০ থেকে ২৫ দিন পর এবং দ্বিতীয় ভাগ ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর ফুল ফোটার আগে দিতে হবে।

সেচ ও পরিচর্যা

সূর্যমুখী ফুলে চাশাবাদে পরিচর্যায় বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, বিশেষ করে চারা গজানোর পর এবং সার দেওয়ার সময় সতর্ক থাকতে হবে।

সূর্যমুখীরর ভালো ফলন জন্য কয়েকবার সেচ দেয়া প্রয়োজন। প্রথম বার সেচ দিতে হবে বীজ বপনের ৩০ দিন পর (গাছে ফুল আসার আগে), দ্বিতীয় বার সেচ দিতে হবে বীজ বপনের ৫০ দিন পর (পুষ্পস্তবক তৈরির সময়) এবং তৃতীয় বার সেচ দিতে হবে বীজ বপনের ৭০ দিন পর (বীজ পুষ্ট হবার আগে)।

এছাড়া নিয়মিত সূর্যমুখী ক্ষেতে আগাছামুক্ত পরিস্কার করতে হবে।  দুই সারির মাঝের মাটি তুলে গাছের গোড়ায় দিতে হয়।

এতে গাছের গোড়া মজবুত হবে, ফলে ঝড়-বৃষ্টিতে সহজে হেলে যাবে না।

রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন

সূর্যমুখী ক্ষেতে বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও রোগবালাইে  আক্রান্ত হয়ে থাকে, এতে ফলন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এই ফুল চাষিদের পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা থাকা জরুরী।

বিছা পোকা:

  • বিছা পোকা ছোট অবস্থায় এরা দলবদ্ধভাবে থাকে।
  • এরা সাধারণত গাছের পাতায় আক্রমণ করে, পাতার সবুজ অংশ খেয়ে পাতাকে পাতলা সাদা পর্দার মতো করে ফেলে।
  • পোকা দেখার সংগে সংগে গাছ থেকে পোকাসহ পাতা সংগ্রহ করে পোকা মেরে ফেলতে হবে।
  • সেচ নালায় কেরোসিন মিশ্রিত পানি থাকলে কীড়া পানিতে পড়ে মারা যায়।

এই পোকার আক্রমণ বেশি হলে নাইট্রো (সাইপরমেথ্রিন+ ক্লোরোপাইরিপস) ২০ ইসি ২ মিলিলিটার প্রতি লিটার পানিতে আক্রান্ত ক্ষতে ১০ দিন অন্তর অন্তর ২ বার ছিটিয়ে পোকা দমন করা যাবে।

পাতা ঝলসানো রোগ

  • অলটারনেরিয়াহেলিয়ানথী নামক ছত্রাকের সাহায্যে এ রোগ ছড়ায়।
  • আক্রমণের শুরুতে পাতায় ধুসর বা গাঢ় বাদামী বর্ণের অসম আকৃতির দাগ পড়ে।
  • এ দাগগুলো একত্রে মিলিত হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে এবং অবশেষে পুরো পাতা ঝলসে যায়।

এ রোগাক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে ছত্রাকনাশক ওষুধ পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন অন্তর অন্তর দুই থেকে তিনবার জমিতে দিতে হবে।

শেকড়পচা রোগ

  • সাধারণত স্কেলেরোশিয়াম রলফসি নামক ছত্রাকের কারণে এ রোগ হয়ে থাকে।
  • আক্রান্ত গাছের গোড়া সাদা তুলার মতো হয়ে গোলাকার দানার মতো দেখায়।
  • প্রথমে গাছ কিছুটা নেতিয়ে পড়ে।
  • কয়েক দিনের মধ্যে পুরো গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে মারা যায়।

ছত্রাকনাশক ওষুধ দিয়ে বীজ শোধনের মাধ্যমে রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব।

জেসিড পোকা

  • পূর্ণবয়স্ক ও বাচ্চা উভয়ই ক্ষতি করে।
  • চারাগাছ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত এরা পাতার রস খায়।,এতে আক্রান্ত পাতা বিবর্ণ হয়ে যায়।
  • পাতা হলুদ হয়ে পরে শুকিয়ে যায়।

দমনের জন্য আক্রান্ত জমিতে ছাই ছিটাতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে চাষাবাদ করতে হবে। এই পোকার আক্রমন বেশি হলে কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে।

ফলন ও ফসল সংগ্রহ

সূর্যমুখী ফুলের বীজ বোনার  ৯০ থেকে ১১০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়। পরিপক্ব হলে গাছের পাতা হলদে হয়ে আসে, পুষ্পস্তবকসহ গাছের মাথা নুয়ে পড়ে, দানাগুলো পুষ্ট, শক্ত ও কালো রং ধারণ করে।

জাতভেদে প্রতি শতক ফলন ৬ থেকে ৭.৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।

 

বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?