ইদানিং বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে। উচ্চ বাজারমূল্য ও অধিক লাভের কারণে স্ট্রবেরির চাষাবাদে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
তবে,এ দেশের আবহাওয়া অনুযায়ী স্ট্রবেরি চাষের উপযুক্ত সময় (রবি মৌসুম) অক্টোবর-নভেম্বর দুই মাস। আজ আমরা এই নিবন্ধে স্ট্রবেরি চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
উন্নত স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি
মূলত মৃদু শীত প্রধান অঞ্চলের ফসল স্ট্রবেরি। তবে, ফুল ও ফল আসার সময় শুকনো আবহাওয়া প্রয়োজন। পানি জমে না এমন উর্বর দো-আঁশ থেকে বেলে-দোআঁশ মাটি এ ফল চাষের জন্য উত্তম।
বীজ অথবা রানার (কচুর লতির মতো লতা) এই দুই পদ্ধতিতে স্ট্রবেরির চারা পাওয়া যায়। তবে, বীজ থেকে তৈরি চারার ফলন একেই পাওয়া যায় না, রানারের চারা থেকে সেই বছরেই ফলন পাওয়া সম্ভব।
যে ভাবে চারা তৈরি করবেন..
- স্ট্রবেরি বংশবিস্তার করে রানারের মাধ্যমে।
- তাই আগের বছরের গাছ নষ্ট না করে সংগ্রহ করতে হবে।
- এবং এ গুলো জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে বপন করতে হবে।
- ওই গাছ থেকে উৎপন্ন রানারের শিকড় বের হলে তা কেটে ৫০ ভাগ গোবর ও ৫০ ভাগ পলিমাটিযুক্ত পলিথিন ব্যাগে লাগাতে হবে।
- এরপর পলিথিন ব্যাগসহ চারা গুলো হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে।
- অতিরিক্ত বৃষ্টি থেকে চারা গুলো রক্ষা করতে উপরে পলিথিনের ছাউনি দিতে হবে।
- রানারের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হলে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমতে থাকে।
- তাই জাতের ফলন ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাথার জন্য টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা ব্যবহার করা ভালো।
মাতৃগাছ রক্ষণাবেক্ষণঃ স্ট্রবেরি গাছ প্রখর সূর্যের আলো ও বেশি বৃষ্টি সহ্য করতে পারে না। এজন্য মার্চ-এপ্রিল মাসে হালকা ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ফল সংগ্রহের পর সুস্থ-সবল গাছ তুলে পলিথিন ছাউনির নিচে রোপণ করলে মাতৃগাছকে সূর্যের খরতাপ ও ভারী বৃষ্টির ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যায়। মাতৃগাছ থেকে উৎপাদিত রানার পরবর্তী সময়ে চারা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
জমি ও চারা বপন
স্ট্রবেরি চাষাবাদের জন্য অন্তত ৩০ সেন্টিমিটার গভীর করে জমি চাষ বা মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা করে নিতে হবে। জমি ভালোভাবে পরিষ্কার করে, পরিমাণ মত সার মাটিতে সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। এছাড়া…
- জমিতে স্ট্রবেরির চারা বপনের জন্য বেড তৈরি করে নিতে হবে।
- প্রতিটি বেডের প্রশস্ত হবে প্রায় ৩ ফুট।
- দুই বেডের মধ্যের নালা হবে ১ থেকে ১.৫ ফুট চওড়া।
- প্রতিটি বেডে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হবে ১.৫-২ ফুট।
- প্রতিটি লাইনে ১-১.৫ ফুট দূরে দূরে চারা রোপণ করতে হবে।
- চারা মধ্য অক্টোবর থেকে মধ্য ডিসেম্বর পর্যন্ত বপন করা যায়।
- তবে নভেম্বর মাস স্ট্রবেরি চারা বপনের জন্য উত্তম সময়।
রোদ এই স্ট্রবেরির গাছের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান। তবে সারাদিন সরাসরি সূর্যালোক থেকে গাছ দূরে রাখা ভালো। সকালের হালকা সূর্যালোক আর শেষ বিকেলের মৃদু রৌদ্র গাছের জন্য উপকারী।
আবার খেয়াল রাখতে হবে রাতের শিশির যেনো গাছের উপর পড়ে। মোট কথা গাছের সঠিক ভাবে বেড়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত রোদ এবং শিশির দুটোই প্রয়োজন।
সার প্রয়োগ
স্ট্রবেরির ভালো ফলনের জন্য দরকার প্রচুর জৈব সার। তবে, মাটি পরীক্ষা করে সার দিলে ফলন ভালো হয়। সাধারণত প্রতি শতক জমিতে…
- গোবর সার ১০০-১২০ কেজি,
- ইউরিয়া সার ১ কেজি,
- টিএসপি সার ৮০০ গ্রাম,
- এমওপি সার ৯০০ গ্রাম,
- জিপসাম সার ৬০০ গ্রাম ব্যবহার করতে হবে।
শেষ চাষের সময় চাষাবাদের জমিতে সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম ও অর্ধেক পরিমাণ এমওপি সার ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া ও অবশিষ্ট এমওপি সার চারা রোপণের ১৫ দিন পর থেকে ১৫-২০ দিন পর পর ৪-৫টি কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
পরিচর্যা ও সেচ
অন্যান্য ফসলের মতো স্ট্রবেরি ক্ষেতে নিয়মিত কিছু পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। ভালো ফলনের জন্য স্ট্রবেরি গাছের বিশেষ যত্ন নিতে হবে।
গাছ থেকে বের হওয়া প্রচুর রানার বা লতা জমি ঢেকে ফেলে; এতে ভালো ফলন সমস্যা হয়।
এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে গাছের গোড়ায় খড় বা পলিথিন বিছিয়ে দিতে হয়।
জমিতে রসের অভাব দেখা দিলে নিয়মিত প্রয়োজনমতো সেচ দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যেনো পানি জমে না থাকে।
কারণ, স্ট্রবেরি জলাবদ্ধতা মোটেই সহ্য করতে পারে না। তাই বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া……
- নিয়ম করে আগাছা পরিষ্কার করার পাশাপাশি মরা পাতা কেটে ফেলে দিতে হবে।
- মাঝে মাঝে মাটি নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হয়।
- গাছে ফুল আসার পর একটু বাড়তি পরিচর্যার প্রয়োজন।
- গাছে ফল ধরার পর খেয়াল রাখতে হবে ফল যেনো মাটি স্পর্শ না করে।
- ফল মাটি স্পর্শ করলে পচে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
- এছাড়াও পাখির আক্রমণ থেকে ফলকে সাবধানে রাখার জন্য, ফুল আসার পর পরই গাছ নেট দিয়ে ঢেকে দেয়া ভালো।
পোকা-মাকড় ও রোগবালাই দমন
স্ট্রবেরির সবচেয়ে বড় শত্রু বুলবুলি পাখি। ফল আসার পর সম্পূর্ণ পরিপক্ক হওয়ার আগেই পাখির উপদ্রব শুরু হয়। এজন্য ফল আসার পর সম্পূর্ণ বেড জাল দিয়ে ঢেকে দিতে হবে যাতে পাখি ফল না খেতে পারে। এছাড়া…
স্ট্রবেরি গাছে পাতায় দাগ পড়া রোগ
- এক ধরণের ছত্রাকের আক্রমণে পাতায় দাগ পড়া রোগ হয়।
- এই রোগের আক্রমণে স্ট্রবেরির ফলন ও ফলের গুণগত মান কমে যায়।
পাতায় দাগ পড়া রোগের প্রতিকারের জন্য অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যেমন-সিকিউর বা রিডোমিল্ড গোল্ড প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
ফল পচা রোগ
- ফল পচা রোগ রোগের আক্রমণে ফলের স্ট্রবেরির গায়ে জলে ভেজা বাদামী বা কালো দাগের সৃষ্টি হয়।
- দাগ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ফল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।
এ জন্য ফল পরিপক্ক হওয়ার আগে অনুমোদিত ছত্রাকনাশক যেমন-নোইন ৫০ ডব্লিউপি অথবা ব্যাভিস্টিন ডিএফ নামক ছত্রাকনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
মাকড়
- মাকড়ের আক্রমণে স্ট্রবেরির ফলন ক্ষমতা ও গুণগত মান মারত্মকভাবে বিঘ্নি হয়।
- এদের আক্রমণে পাতা তামাটে বর্ণ ধারণ করে ও পুরু হয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে কুচকে যায়।
- এতে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যবহত হয়।
এ জন্য ভারটিমেক নামক মাকড়নাশক প্রতি লিটার পানির সাথে ১ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।
টবে বা ছাদ বাগানেই স্ট্রবেরি চাষ
ছাদ বাগানে বা টবে ইদানীং স্ট্রবেরি চাষ হচ্ছে। যাদের বড় পরিসরে চাষ করার মতো জায়গা নেই, তারা চাইলেই ছাদ বাগানে বা বারান্দা বাগানে খুব সহজেই স্ট্রবেরি চাষ করতে পারেন।
যেভাবে টবে বা ছাদ বাগানেই স্ট্রবেরির চাষাবাদ করবেন…
- কোনো মাটির টব অথবা তেল বা পানির বোতল কেটে স্ট্রবেরি গাছ লাগানো যাবে।
- টবে বা বোতলের ছিদ্র করে নিতে হবে যাতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকে।
- এরপর মাটি প্রস্তুত করে নিতে হবে (শুকনো গোবর বা জৈব সার মিক্সড করে)।
- রোদ স্ট্রবেরিগাছের জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান (তবে সারাদিন সরাসরি সূর্যালোক থেকে গাছ দূরে রাখতে হবে)।
- নার্সারী থেকে ভালো জাতের চারা সংগ্রহ করতে হবে।
- স্ট্রবেরি গাছের নিয়মিত পরিচর্যার প্রয়োজন হয়।
- আগাছা পরিষ্কার, মরা পাতা কেটে ফেলে দেয়া, মাঝে মাঝে মাটি নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হয়।
- প্রতিদিন অল্প করে পানি দিতে হবে।
- তবে খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যেনো পানি জমে না থাকে।
আর স্ট্রবেরি চাষে তেমন কোন সার এর প্রয়োজন হয় না। তবে ১৫-২০দিন অন্তর অন্তর সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া সার টবের চারপাশের মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া ভালো (গাছের গোড়ায় দেয়া যাবে না, আর সার দেবার পর অবশ্যই পানি দিতে হবে)।
ফল সংগ্রহ
স্ট্রবেরির কাঁচা ফল যখন হলদে বা লালচে রঙের হতে শুরু করে তখন বুঝা যাবে ফল পাকা শুরু হয়েছে। ফল পুরো পাকলে লাল হয়ে যায়।
তবে বিক্রির জন্য ফল পুরো লাল হওয়ার দরকার নেই। সেক্ষেত্রে ফলগুলো শক্ত থাকা অবস্থায় তুলতে হবে। আর ফল তুলতে হবে বোটা সমেত।
–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
আরো পড়ুন …
- জেনে নিন উন্নত সরিষা চাষ পদ্ধতি
- যেভাবে সহজে পুঁইশাক চাষ করবেন
- সহজ বাটিশাক চাষ পদ্ধতি
- সঠিক বাদাম চাষ পদ্ধতি
- মাশরুম চাষ করুন, ঘরে বসে খুব সহজেই!
- মিষ্টি আলু চাষ পদ্ধতি
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।