সঠিক বাদাম চাষ পদ্ধতি

কম খরচে ভালো ফলন পাওয়া ফসল বাদাম চাষ করে ভাগ্য খুলছে কৃষকদের। দেশের চরাঞ্চলের পলিমাটিতে বাদামে ভালো ফলনের আশায় স্বপ্ন বুনছেন কৃষকরা।

তাই আজ আমরা চীনা বাদামের চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এই নিবন্ধে।

ঝুরঝুরে মাটিতে বাদাম চাষ

সুনিষ্কাশিত দোআঁশ বা বেলে দোআঁশ মাটি চীনা বাদাম চাষের জন্য বেশি উপযোগী।

তবে, চিনা বাদাম গর্ভাশয়ের নীচের যে বৃন্তটি শুঁটি গঠন করে, সেটি মাটির নীচে চলে যায় এবং সেখানে পুষ্ট হয়ে বাদামে পরিণত হয়। এই কারণে ভাল নিকাশি ব্যবস্থা আছে এমন হাল্কা, ঝুরঝুরে দোঁয়াশ মাটিতে বাদাম চাষ করা উচিত।

বীজ বপনের সময়

দেশে অনেকেই প্রাক-খরিফ মরসুমে চিনাবাদামের চাষ করে থাক। তবে খরিফ ও রবি মৌসুমের তুলনায় ফাল্গুন-চৈত্র মাসে চিনা বাদাম চাষাবাদ বেশি করে কৃষকরা।

  • চীনাবাদাম চাষাবাদের উপযুক্ত সময় সাধারনত এপ্রিল মাস থেকে ‍জুন মাসের মাঝামাঝি।
  • তবে রবি মৌসুমে চাষাবাদের জন্য আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি থেকে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বীজ বোনা উত্তম।
  • বাদাম চাষে বীজের পরিমান বাদামের জাতের উপর নির্ভর করে থাকে।
  • সাধারনত এক হেক্টর জমির জন্য খোস সহ বাদাম ৯৫-১০০ কেজি প্রয়োজন হয়।

জমি তৈরি ও বীজ বপন পদ্ধতি

বাদামের ভালো ফলন পেতে জমি ভালোভাবে ৩-৪ বার চাষ বা মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। জমি তৈরি নালার সুব্যবস্থা রাখতে হবে সেচ দেওয়ার জন্য।

এছাড়া…….

  • মাটি শোধনের জন্য এক একর জমিতে ১০০ কেজি পচানো গোবর সারের সঙ্গে এক কেজি উপকারী ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া মিশিয়ে, পানি দিয়ে এক সপ্তাহ আর্দ্রতা ও ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। এতে উপকারী ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ১০-১২ গুণ বৃদ্ধি পাবে।
বীজ বপন পদ্ধতি
  • চীনাবাদামের বীজ বোনার আগে ভালো করে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে।
  • খোসা ছাড়ানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে বীজের উপরের পাতলা পর্দা যাতে নষ্ট না হয়।
  • খোসা ছাড়ানোর পর পরই বীজ বোনতে হয়।
  • তবে খোসা ছাড়ানোর ২-৫ দিনের মধ্যে বীজ বপন করা যায়।
  • সাধারনত চীনাবাদামের বীজ সারিতে বোনা উচিত।
  • এক সারি থেকে আরেক সারির দূরত্ব হবে ৪৫ সেমি এবং এক বীজ থেকে আরেক বীজের দূরত্ব হবে ১৫ সেমি।
  • বীজ বোনতে হবে ৫ সেমি গভীর।
  • জমিতে বীজ বোনার সময় পর্যাপ্ত রস থাকতে হবে।
  • যদি মাটিতে রসের পরিমান কম থাকে তাহলে জল সেচ দিতে হবে।
  • প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম উপকারী ছত্রাক (ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি) মিশিয়ে অথবা প্রতি কেজি বীজে ৫ গ্রাম ক্যাপটান মিশিয়ে বীজ শোধন করলে বেশ কিছু রোগের আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

উল্লেখ্য, দাঁড়ানো জাত হলে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০-৩০ সেমি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব অন্তত ১৫ সেমি হওয়া চাই। ছড়ানো জাতের ক্ষেত্রে সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩০-৪৫ সেমি ও গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১৫ সেমি।

বীজ বপনের ২৪ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে যেহেতু বাদাম গাছে ফুল আসে, সেহেতু ২০ দিনের মাথায় প্রতি একরে ৮০ থেকে ২০০ কেজি জিপসাম, ৭ থেকে ১৪ কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ প্রয়োগ করা উচিত।

  • এতে বেশি সংখ্যক ও গুণমানের শুঁটি মেলে। চুন প্রয়োগ করলে অর্বুদ ও শুঁটির গঠন ভাল হয়।
  • শুঁটি গঠন ও বৃদ্ধিতে আলফা ন্যাপথলিন অ্যাসেটিক অ্যাসিডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
  • তাই ফুল আসার সময় ২৫-৪০ ও ৫০-৬০ দিনের মধ্যে আলফা এনএএ-এর দু’বার ব্যবহার ফলন বাড়ায়।

সারে পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি

চীনাবাদামের ভালো ফলন পেতে জমিতে প্রয়োজন অনুসারে সার প্রয়োগ করতে হবে। এই ফসলের চাষাবাদে হেক্টর প্রতি …

  • গোবর সার ৫-৭ টন (পচা)।
  • ইউরিয়া ২০-৩০ কেজি।
  • ১৫০-১৭০ কেজি টিএসপি।
  • এমওপি ৮০-৯০ কেজি।
  • জিপসাম ১৬০-১৮০ কেজি প্রয়োজন হয়ে থাকে।

প্রয়োগ পদ্ধতি…

জমি শেষ বার চাষ করার সময় বীজ বপন করার আগে জমিতে সার প্রয়োগ করতে হবে।

  • শেষ বার চাষের সময় ইউরিয়া সারের অর্ধেক ছাড়া বাকি সব সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে বীজ বপন করার ৪০-৫০ দিন পর যখন গাছে ফুল আসবে।
  • তবে জমিতে অনুবীজ সার ও প্রয়োগ করা যেতে পারে।
  • এই সার প্রয়োগ করতে হবে এক কেজি বীজের জন্য ৭০ গ্রাম।
  • তবে অনুবীজ সার প্রয়োগ করলে জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করার দরকার হয় না।
  • সার প্রয়োগ করার পর প্রয়োজনে জল সেচ দিতে হবে।

সেচ ব্যবস্থা ও আগাছা দমন

উন্নত ফলন পেতে একটা সেচ দিয়ে জো অবস্থায় বীজ বপন করতে হবে। বেলে মাটি হলে ৫ দিন অন্তর, দোঁয়াশ মাটি হলে ১০ দিন অন্তর হাল্কা সেচ দেওয়া উচিত।

এছাড়া…

  • ফুল আসা ও শুঁটি পাকার সময় যেন অবশ্যই সেচ দেওয়া হয়।
  • নিয়মিত জমির আগাছা ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে।
  • বীজ বোনার ১৫-২০ দিন পর একবার করে নিড়ানি দিতে হবে।
  • প্রয়োজনে মাটি হালকা কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে।

মাটি যদি বেশি শক্ত হয়ে যায় তাহলে গাছে ফুল ধরার আগে গাছের গোড়ায় মাটি চেপে দিতে হবে।

রোগ ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা

চীনা বাদাম ক্ষেতে সাধারনত বিছা পোকা, উইপোকা আক্রমন করে থাকে। এছাড়া অন্যান্য রোগে আক্রমন করে থাকে তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

  • বিছাপোকা আক্রমন করলে ডায়াজিনন ৬০ ইসি এক লিটার জলের সাথে এক মিলি পরিমান মিশিয়ে জমিতে স্প্রে করতে হবে।
  • উইপোকা আক্রমন করলে জমিতে কেরোসিন মিশিয়ে সেচ দিতে হবে।

এছাড়া…

চীনা বাদাম গাছে পাতার দাগ রোগ দেখা যায় ও পাতায় মরিচা রোগ দেখা যায়। জমিতে রোগ আক্রমন করলে উপযুক্ত ছত্রাক নাশক স্প্রে করতে হবে।

  • টিক্কা রোগ:  বীজ আর মাটি শোধন করলে এই রোগের আক্রমণ কমে।
  • গোড়াপচা রোগ: এই রোগে আক্রান্ত হলে গোড়ায় কালো দাগ পড়ে ও শিকড় পচে যায়। ফলে কচি চারাগাছ মারা যায়। এই রোগের প্রতিকার হিসাবে প্রতি লিটার পানিতে কার্বেন্ডাজিম ৫০% ডব্লুপি ১ গ্রাম মিশিয়ে বা পেনসাইকিরন ১.৫ মিলি অথবা ভ্যালিডামাইসিন ৩% এল ২ মিলি ভাল করে মিশিয়ে বিকেলের দিকে গাছের গোড়ায় ছেটাতে হবে।
ফলন ও ফসল সংগ্রহ

সঠিক উপায়ে চীনা বাদামের চাষাবাদ প্রতি হেক্টর জমিতে ২-২.৫ টন বাদামের ফলন পাওয়া যেতে পারে।

ফলন সংগ্রহের ক্ষেত্রে বীজ বপনের পর গুচ্ছ জাতের ক্ষেত্রে ৮৫-৯৫ দিন, ছড়ানো জাতের ক্ষেত্রে ১০০-১১০ দিন ও হাইব্রিড জাতের ক্ষেত্রে ১১০-১২৫ দিন সময় লাগে।

বাদাম পরিপক্ক হবার পর তা সংগ্রহ করতে হবে। গাছের পাতা যখন হলুদ হয়ে যাবে এবং গাছের নিচের দিকের পাতা যখন ঝরে পড়তে শুরু করবে তখন ফল সংগ্রহ করতে হবে।

এ সময় একটি বা দুটি গাছের গোড়ার মাটি খুড়ে বাদামের রং পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তারপর বাদাম সংগ্রহ করতে হবে। বাদাম সংগ্রহের পর ৩-৪ দিন ভালো করে রোদে শুকাতে হবে।

–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।  বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?