যেভাবে সঠিক পদ্ধতিতে ব্রকলি চাষ করবেন

বাংলাদেশে বর্তমানে অনেকে কৃষক ফুলকপির মতো দেখতে গাড় সবুজ রঙের ব্রকলি চাষ করেছেন। এ দেশে মাত্র কয়েক বছর আগে ব্রকলি উৎপাদন শুরু হয়।

তাই,বাণিজ্যিকভাবে এখনো পরিচিত হয়ে ওঠেনি।

তবে, অপরিচিত ও অপ্রচলিত ব্রকলি চাষ ইদানিং বেশ জনপ্রিয় হয়েছে, মানুষও দাম দিয়ে এই সবজি কিনছে। এ কারণে কৃষকও লাভের মুখ দেখছে।

আপনি চাইলে বাড়ির আঙিনায়, টবে বা ছাদ বাগানে ব্রকলি চাষ করতে পারেন। আজ আমারা এই নিবন্ধে আধুনিক ব্রকলির চাষ পদ্ধতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আদ্যোপান্ত আলোচনা করব।

ব্রকলি চাষ পদ্ধতি

মূলত এদেশে শীতের সবজি চাষের সময় জমিতেই ব্রকলি চাষ করছে কৃষকরা। ব্রকলি চাষে পরিমিত সার ও কীটনাশক ব্যবহার করলেই চলে।

তবে এখনে যেসব সার ও কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়, তার গুণগতমান খুব একটা ভালো না।

কৃষকরা জানান, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রোপণ করা হয় ব্রকলির চারা। নিবিড় পরিচর্যার পর আড়াই মাসেই ফুল ধরেছে। এই ফুলই ব্রকলি।

জাত ও চাষের সময়

নাতিশীতোষ্ণ সবজি ব্রকলির চাষাবাদের ঠান্ডা ও আদ্র জলবায়ু উপযুক্ত। উচ্চ তাপমাত্রা ও খরাসহিষ্ণু ব্রকলি বাংলাদেশের শীতকালীন আবহাওয়ায় চাষের জন্য খুব উপযোগী।

তবে, পর্যাপ্ত সূর্যালোকেরও প্রয়োজন। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস ব্রকলি চাষের উত্তম সময়। তবে আগস্ট মাসের পরই জমি প্রস্তুত করে বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে।

এছাড়া…

  • ব্রকলির ভালো ফলনের জন্য বীজতলায় চারা তৈরি করে মূল জমিতে লাগাতে হবে।

    উচ্চফলনশীল ব্রকলি বীজ (হাইব্রিড)
    উচ্চফলনশীল ব্রকলি বীজ (হাইব্রিড)
  • চারা চেনার জন্য যে বিষয় গুলো খেয়াল রাখবেন, তা হলো চারার উচ্চতা ৮-১০ সেমি, ৫-৬টি সবল পাতা ও গাঢ় সবুজ বর্ণ।
  • বীজ বোনার পর চারা গজাতে ৩-৪ দিন সময় লাগে।
  • ১২-১৫ দিন বয়সে চারা মূল জমিতে বপনের উপযুক্ত হয়।
  • তবে ৩-৪ সপ্তাহের সুস্থ চারা জমিতে লাগালে ভালো হয়।
  • টবে চাষের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন, যেন ছোট না হয়ে যায়। তাই ৫ লিটার পাত্রের সমান টবে লাগাবেন।
  • বিভিন্ন কোম্পানি ব্রকলি বীজ বাজারজাত করছে। তবে ভালো জাতের বীজ নির্বাচন করতে হবে।
  • এক হেক্টরে চাষের জন্য ১৫০ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
  • বীজ বোনার সময় ভাদ্র-আশ্বিন (মধ্য আগস্ট-মধ্য অক্টোবর) মাস পর্যন্ত।
  • কার্তিক (মধ্য-নভেম্বর) মাস পর্যন্ত বীজতলায় বীজ বোনা যায়।
  • তবে সেপ্টেম্বরের শেষে সপ্তাহ বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।

মাটি ও সার প্রয়োগ

বেলে দোআঁশ, দোআঁশ ও এঁটেল মাটিতে ব্রোকলি চাষ ভালো হয়। তবে  ব্রকলির ভালো ফলনের জন্য মাটিতে যথেষ্ট পরিমাণে জৈবসার থাকা প্রয়োজন।

মাটি উর্বর ও মাটির অম্ল-ক্ষারত্ব (PH) ৬.০-৭.০ হলে ভালো। এছাড়া সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন জমি ব্রোকলি চাষাবাদের জন্য  নির্বাচন করতে হবে।

  • ব্রকলি চাষে মাটি ভালভাবে চাষ ও মই দিয়ে নরম ও ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হয়।
  • মাটি নরম তুলতুলে থাকলে ভালো ফলন হয় ও ব্রকলি তাড়াতাড়ি বাড়ে।
  • সারাদিন রোদ থাকে এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।
  • পরিমাণমতো গোবর, টিএসপি ও খৈল দিয়ে সার ও মাটি ভালো ভাবে মিশিয়ে নিতে হবে।
  • জৈবসার ও গোবর সার ১ ভাগ, বালু ১ ভাগ ও মাটি ২ ভাগ মিশিয়ে বীজতলা তৈরি করে নিতে পারেন।
  • ব্রোকলি চাষে জন্য প্রতি একর জমিতে ৬ টন গোবর, ইউরিয়া ১০০ কেজি, টি এস পি ৭০ কেজি ও পটাশ ৫৫ কেজি প্রয়োগ করতে হয়।
  • জৈব সারের সাথে ইউরিয়া সার চারা রোপণের ১৫ দিন পর থেক দুই কিস্থিতে সমান ভাগ করে দিতে হবে।

জমিতে সারের কমতি হলে গাছের বৃদ্ধি আশানুরূপ হয় না এবং ফলন কমে যায়। তাই, ব্রকলি চাষের জমিতে যাতাযত নিয়মে সার প্রয়োগ অত্যাবশ্যক।

জমি ও বীজতলা তৈরি এবং চারা উৎপাদন

ব্রকলি চাষে জন্য সূর্যালোক পায় এমন জমি প্রথমে ভালোভাবে চাষ দিয়ে প্রস্তুত করে নিতে হবে।

এছাড়া…

  • জমিতে ভালোভাবে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরা ও সমান করে তৈরি করতে হবে।
  • দুই সারিতে চারা রোপণের জন্য জমির চওড়া ও ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার উঁচু বেড তৈরি করতে হবে।
  • দুটি পাশাপাশি বেডের মাঝখানে যাতায়াত ও পানি নিষ্কাশনের জন্য ৩০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত এবং ১০-১৫ সেন্টিমিটার গভীর নালা রাখতে হবে।
  • নালার মাটি তুলে বেড উঁচু করতে হবে।

অন্যদিকে ব্রকলি চাষের জন্য চারা উৎপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • চারা উৎপাদনের জন্য পানি নিষ্কাশনের সুবিধাসহ উন্মুক্ত জায়গা, বীজতলা তৈরির উপযুক্ত স্থান।
  • তা ছাড়া বীজতলায় সেচ দেয়ার জন্য কাছে পানির উৎস থাকা উত্তম।
  • বীজতলার মাটি অত্যন্ত মিহি করে তৈরি করতে হয়।
  • এঁটেল মাটি হলে কিছু ভিটি বালি মিশিয়ে নিলে ভালো হয়।
  • বীজ বপনের জন্য ৩ মিটারী ১ মিটার বীজতলা হওয়া দরকার।

প্রথম বীজতলায় ঘন করে বীজ ফেলতে হবে, বীজ গজানোর ১০-১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায় স্থানান্তর করতে হয়।

  • দ্বিতীয় বীজতলায় ৫-০ সেন্টিমিটার দূরত্বে সারিতে ২.৫ সেন্টিমিটার দূরে চারা রোপণ করতে হবে।
  • চারা রোপণের পরপরই সেচ ও ছায়া দিতে হয়। কারণ চারা প্রতিষ্ঠিত হতে ৫-৬ দিন সময় লাগবে।
  • এ সময় একদিন পরপর সেচ দিতে হবে। পরবর্তীতে ৫-৭ দিন পরপর সেচ দেয়া দরকার।

এতে চারা শক্তিশালী হয়। অতিরিক্ত সেচ দিলে চারা লিকলিকে, লম্বা ও দুর্বল হয় এবং পরবর্তী এমন গাছ থেকে ফলন আশানুরূপ হয় না।

দ্বিতীয় বীজতলায় চারা স্থানান্তরের ৭-৮ দিন আগে প্রতিটি বীজতলায় ১৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ১০০ গ্রাম এমওপি প্রয়োগ করতে হয়।

চারা বৃদ্ধির হার কম হলে প্রতিটি বীজতলায় ৮০-১০০ গ্রাম ইউরিয়া মাটিতে রসযুক্ত অবস্থায় প্রয়োগ করতে হয়।

সেচ ও পরিচর্যা

মূল জমিতে ব্রকলির চারা বপনের প্রথম এক সপ্তাহ; একদিন পরপরই হালকা সেচ দিতে হবে। পরবর্তীতে ৮-১০ দিন অন্তর বা প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দিতে হবে।

এছাড়া…

  • জমি সব সময় আগাছা মুক্ত রাখুন।
  • পরিমাণমতো জৈব সার ব্যবহার করুন।
  • সার প্রয়োগের পর পানি দিন।
  • সেচ দেয়ার পর জমিতে ‘জো’ আসলে ব্রোকলি স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে।
  • পানি সেচ ও নিষ্কাশনের জন্য নালা সর্বদা পরিষ্কার রাখতে হবে, সেচের অতিরিক্ত পানি বা বৃষ্টির পানি জমি থেকে বের করে দিতে হবে।

পোকা ও রোগবালাই দমন

ব্রকলি ক্ষেতে পোকার আক্রমণ হতে পারে। পোকা দমনের জন্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।

  • এছাড়া অন্যান্য পোকার মধ্যে রয়েছে ক্রসোডলমিয়া লেদা পোকা, বিছা পোকা, ঘোড়া পোকা ইত্যাদি।
  • ব্রকলি বিভিন্ন ধরণের রোগের মধ্যে আছে পাতায় দাগ ও কালো পচা রোগ প্রধান সমস্যা।
  • এছাড়া চারা ধ্বসা, গদাই মূল, মোজাইক, ইত্যাদি রোগ দ্বারা আক্রমণ হয়ে থাকে।
  • ব্রকলি ক্ষেতে জাব পোকা ও শুঁয়ো বেশি হলে রিডেন, মার্শাল বা নাইট্রো স্প্রে করা যেতে পারে।
  • তবে তা কোন কৃষি কর্মকতার পরামর্শ অনুযায়ী করলে ভালো হয়।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেন, ‘শীতকালীন সবজিতে পাতার নিচে মাকড়, জেসিড ও হোয়াইট ফ্লাই বেশি আক্রমণ করে।

আমাদের কৃষকরা সময় মতো সঠিক ওষুধটি নির্দিষ্ট মাত্রায় দিতে পারেন না বলে পোকা-মাকড় ধ্বংস হয় না।

এ কারণে খরচও বেশি পড়ে।

মাকড় প্রধানত গাছের পাতার নিচে থাকে, সেক্ষেত্রে মাকড়নাশক ওষুধ স্প্রে করতে হয় পাতার নিচে।

অর্থাৎ গাছের গোড়ায় স্প্রের মুখ রেখে ওষুধ স্প্রে করলে মাকড়ের গায়ে লাগবে। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ কৃষক পাতার উপরের দিকে স্প্রে করে চলে যায়।

এছাড়া এই সব ওষুধ স্প্রে করার উপযুক্ত সময় হচ্ছে বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে।

কেননা ওই সময় তাপমাত্রা কম থাকে, পোকা-মাকড়গুলোও তাদের আশ্রয়স্থলে এসে হাজির হয়। কিন্তু দেখা যায়, অধিকাংশ কৃষক খুব সকালে ওষুধ স্প্রে করেন।

সে কারণে ওষুধে কাজ হচ্ছে না বলে তারা মনে করেন।’

ফলন ও ফসল সংগ্রহ

সঠিকভাবে পরিচর্যা করলে হেক্টরপ্রতি ব্রকলির ফলন পাওয়া যায় ১২-১৩ টন।  ব্রোকলির চারা বপনের ৬০-৭০ দিনের মধ্যে পুষ্পমঞ্জুরি সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।

ধারালো ছুরি বা ব্লেড দ্বারা তিন ইঞ্চি কা-সহ পুষ্প মঞ্জুরি কেটে সংগ্রহ করতে হয়। এভাবে একই জমি থেকে ১ মাসব্যাপী কয়েকবার ব্রোকলি সংগ্রহ করা যায়।

ব্রোকলি সংগ্রহের সময় ফুলের উপরের অংশটা সাবধানে কেটে নিবেন। তাহলে পাতার গোড়া থেকে আবার ফুল বের হবে, যা পরবর্তীতে সংগ্রহ করতে পারবেন।

–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।  বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?