সারা বছরেই দেশে প্রায় সব জায়গায় পুঁইশাক চাষ করা যায়। এছাড়া বাড়ির ছাদ কিংবা ব্যালকনিতেও খুব সহজে এই সবজির চাষ করা সম্ভব।
আমাদের দেশে দুই ধরনের পুঁইশাক পাওয়া যায়।
সঠিক পদ্ধতিতে পুঁইশাক চাষ করলে বেশি লাভবান হওয়া যায়। তাই আজ আমরা পুঁইশাকের চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এই নিবন্ধে।
সহজ পুঁইশাক চাষ পদ্ধতি
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে পুঁইশাক জন্মে। সব ধরনের মাটিতেই পুঁইশাক চাষ করা যায়।
তবে পুঁইশাক বেলে দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে এবং গরম, আর্দ্র আবহাওয়া ও রোদেলা স্থানে সবচেয়ে ভালো হয়। কম তাপমাত্রায় গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কম হয়।
তাই বাণিজ্যিকভাবে পুঁইশাক চাষের ক্ষেত্রে দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও এঁটেল মাটিযুক্ত জমি বেছে নিতে হবে।
পুঁইশাকের দুটি জাত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে,- লাল রঙের জাত (এর পাতা ও কাণ্ড লালচে রঙের)। অন্যটি সবুজ রঙের জাত (এর পাতা ও কাণ্ড সবুজ)।
জমি তৈরি ও বীজ বা চারা বপন
- পুঁইশাকের চাশাবাদের জন্য ৫- ৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমির মাটির তৈরি করতে হবে।
- উত্তমরূপে আগাছা পরিস্কার করতে হবে।
- বীজ সারি করে বপন করা যায়।
- চারা উৎপাদন করে ১৫-২০ দিনের চারা লাগানো যায়।
- চারা বপনের জন্য সারি থেকে সারি ১ মিটার।
- এবং প্রতি সারিতে ৫০ সেন্টি মিটার দূরে দূরে চারা বপন করতে হয়।
- বীজ বপনের সময় ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ (বীজ ২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরে জমিতে বুনতে হয়)।
- সারিতে বোনলে প্রতি শতকে ৮-১০ গ্রাম ও হেক্টর প্রতি ১.৫-২.৫ কেজি বীজ লাগে ( তবে ছিটিয়ে বোনলে বীজের পরিমাণ বেশী লাগবে)।
- কখনও কখনও বেডে চারা তৈরি করা হয়।
- ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত চারা তৈরির জন্য বেডে বা পলিব্যাগে বীজ বোনা যায়।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি
পুঁইশাক চাষে প্রতি শতক সারের পরিমান হল…
- ৬০ কেজি গোবর সার,
- সরিষার খৈল ৫০০ গ্রাম,
- ৮০০ গ্রাম ইউরিয়া,
- টিএসপি ৪০০ গ্রাম,
- এমও পি ৪০০ গ্রাম।
জমি তৈরির সময় ইউরিয়া ছাড়া সব সার ( গোবর ও টিএসপির অর্ধেক জমি তৈরীর সময় এবং বাকি অর্ধেক চারা রোপণের সময় গর্তে ) প্রয়োগ করতে হবে।
এছাড়া, চারার বয়স ১০-১২ হলে ইউরিয়া সার প্রথম কিস্তি ৩০-৪০ দিন পর এবং প্রথমবার ফলন তোলার পর বাকি দুই কিস্তি এই মোট তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও পরিচর্যা
- বর্ষাকালে সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয় না (মাটিতে রস না থাকলে অবশ্যই সেচ দিতে হবে)।
- প্রায়ই মাটি আলগা এবং আগাছা পরিস্কার করে দিতে হবে।
- পুঁইশাক গাছের গোড়ায় কখনই পানি জমতে দেয়া যাবে না ( তাহলে গাছের গোড়া পচে যেতে পারে)।
- ফলন বেশী পেতে হলে বাউনি দিতে হবে।
- চারা ২৫-৩০ সেন্টিমিটার উঁচু হলে আগা কেটে দিতে হয় (এতে গাছ ঝোপালো হয়)।
- অনেক বৃষ্টিপাত হলে দেখা যায় যে গোড়ার মাটি ধুয়ে যায়।
- তাই বৃষ্টির পর গাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগদমন
বিট্ল বা ফ্লি বিট্ল ছাড়া পুঁইশাকে আর কোন পোকা তেমন ক্ষতি করে না। এছাড়া, সারকোস্পোরা পাতায় দাগ পুঁইশাকের মারাত্মক একটি রোগ।
পুঁইশাক পাতার দাদ রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
- পাতার দাগ রোগ ছত্রাক দ্ধারা সংঘটিত হয়ে থাকে ( এটি মূলত বীজ বাহিত)।
- বাতাস, বৃষ্টি ও সেচের পানি দ্ধারা রোগটির জীবাণুর বিস্তার ঘটে থাকে।
- এ রোগ হলে প্রথমে পাতায় ছোট ছোট স্পট বা দাগ দেখা যায়।
- পরবর্তীতে দাগগুলো একত্রিত হয়ে বড় আকার ধারণ করে।
- এক সময় পুরো পাতায় দাগ ছড়িয়ে পড়ে।
- তখন পাতার গুণগত মান নষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে পুরো গাছ মরে যায়।
- প্রতিকারের জন্য বপনের আগে প্রোভেক্স ২০০ দ্ধারা বীজ শোধন করতে হবে।
- প্রতি কেজি বীজের জন্য মাত্র ২.৫ গ্রাম ছত্রাকনাশক ব্যবহার করতে হবে।
- এছাড়া রোগের প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত পাতা উঠিয়ে ফেলতে হবে।
- তবে রোগাক্রান্ত পাতা খাওয়াতে কোন অসুবিধে নেই।
- রোগের মাত্রা বেশি হলে কার্বেন্ডাজিম বা ডাইফেনোকোনাজল বা প্রোপিকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
- পড়ন্ত বিকেল বেলায় স্প্রে করলে ভাল হয়।
কাটুই পোকা বিকৃতি রোগ
- ছোটো শুয়ো পোকা কচি পাতায় অনিয়মিত ছোট ছোট গর্ত করে এবং কান্ডের কাছাকাছি মাটির নিচে থাকে।
- বয়স্ক কীড়া ফসলের কান্ডের গোড়ায় খাওয়ার জন্য রাতে মাটি থেকে বাইরে আসে।
- অপ্রাপ্ত বয়স্ক কাটুই বা শুয়োপোকা কচিপাতায় অনিয়মিতভাবে ছোট ছোট ছিদ্র করে এবং মাটির কাছাকাছি পত্রপল্লবে থাকে।
- এদের অনুরূপ বয়স্ক পোকা বাঁধাকপি গাছের গোড়া খাওয়ার জন্য রাতে মাটি থেকে বেরিয়ে আসে।
- কচি বাঁধাকপি গাছ মাটির নিচে টেনে নিয়ে যেতে পারে।
- মাটির নিকটের কান্ড বেশি খায় যা ফসলের বর্ধিষ্ণু কলার ক্ষতি বা বৃদ্ধি ব্যাহত করে বা মৃত্যু ঘটায়।কাটুই পোকা কান্ডের মধ্যেও সুরঙ্গ তৈরি করে, যার ফলে বয়স্ক গাছ ঝিমিয়ে বা ঢলে পড়ে।
- প্রতিকারের জন্য পোকার সর্বোচ্চ সংখ্যা এড়াতে আগাম চাষ করতে হবে।
- রোপনের পূর্বে এবং অঙ্কুরোদগমের পর জমির সর্বত্র আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
- মথ পর্যবেক্ষণ এবং ধরার জন্য আলো ও ফেরোমেন ব্যবহার করা যায়।
- ফসল সংগ্রহের অবশিষ্টাংশ মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
রাসায়নিক সার ছাড়া টবে পুঁইশাক চাষ পদ্ধতি
রাসায়নিক সার ব্যবহারে পুঁইশাকের পাতা আকারে ছোট হয় আর দাগে ভরে যায়। আর পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো না হলে প্রায়শই গোড়া পঁচা রোগ দেখা দেয় ।
জেনে নিন রাসায়নিক সার ব্যবহার ছাড়া পুঁইশাকের চাষাবাদ পদ্ধতি
- টবে পুঁইশাক চাষের জন্য অর্ধেক দোআঁশ মাটি ও অর্ধেক গোবর সার দিতে হবে।
- বড় আকারের টব কিংবা সিমেন্টের বস্তায় পুঁই গাছ লাগাতে পারেন।
- মাটি ও সার মিশানো মাটিতে বীজ বোনে হালকা পানি দিতে হবে।
- বীজ লাগানোর আগে ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ রোগ মুক্ত করা উত্তম।
- এছাড়া বীজ পানিতে ভিজিয়ে টবে বোনলে অঙ্কুরোদগম ভালো হয়।
- পুঁইশাক বেড়ে ওঠার জন্য কোনরকম রাসায়নিক বা কৃত্রিম সার দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়।
- পুঁইশাকের জন্য ভীষণ প্রয়োজনীয় হলো জৈব সার।
- এর জন্য সরিষার খৈল দিয়ে তরল সার বানিয়ে ১৫ দিন অন্তর টবে দিয়ে দিতে হবে।
- সাথে শাক সবজি খোসা পচিয়ে তৈরি সার দিতে হবে।
- সার গাছের গোড়া থেকে যেন ৬ ইঞ্চি দূরে গর্ত করে সার প্রয়োগ করতে হবে।
- গাছের পাতা অনেক সময় কুঁকড়ে যায়। গাছে পোকা হয় তার ফলে পাতা ফুটো ফুটো হয়ে যায়।
- এর জন্য বাড়িতেই তৈরি করে ফেলতে পারেন প্রাকৃতিক কীটনাশক।
- নিমপাতা ফুটিয়ে তার পানি দিতে পারেন। এতে অনেকটা উপকার পাওয়া যায়।
- অনেক সময় পুঁইশাকের গাছের গোড়ায় ছত্রাকের আক্রমণ দেখা যায়। তার জন্য গোড়ায় ছাই দিন।
- এটি করলে পুঁইশাক এর রোগ বালাই থেকে অনেকটা দূরে থাকবে।
আগাছা ও নিড়ানি
- টবের ভিতরে আগাছা জমতে পারে তাই খেয়াল করে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
- ফলন বেশি পেতে হলে বাউনি দিতে হবে।
- পুঁইশাক গাছের গোড়ায় কখনই পানি জমতে দেয়া যাবে না। তাহলে গাছের গোড়া পচে যেতে পারে।
- আবার অনেক বৃষ্টিপাত হলে দেখা যায় যে গোড়ার মাটি ধুয়ে যায়।
- তাই বৃষ্টির পর গাছের গোড়ায় মাটি দিয়ে চেপে দিতে হবে।
- চারা ২৫-৩০ সেন্টিমিটার উঁচু হলে আগা কেটে দিতে হবে, এতে গাছ ঝোপালো হয়।
ফলন ও ফসল সংগ্রহ
পুঁইশাকের ফলন প্রতি শতকে ৮০ থেকে ১২০ কেজি, হেক্টর প্রতি ৫০ থেকে ৭০ টন। লাল রঙের জাত মনীষা বীজ বপনের ৪০-৪৫ দিন পই তোলা শুরু করা যায়।
আর সবুজ রঙের জাতের মধ্যে ভাল বারি পুইশাক ১ (চিত্রা)। এ জাতের ফলন হেক্টর প্রতি ৪০-৫০ টন সবুজ রঙের অন্যান্য জাত হল মাধুরী ও রূপসা গ্রীন।
পুঁই গাছের ডগা মাঝে মাঝে কেটে দিতে হয়। এতে শাকও খাওয়া হয় আবার গাছে নতুন ডগাও বেরোয়। একবার চারা লাগিয়ে ৮ থেকে ১০ বার পুঁইশাক সংগ্রহ করা যায়।
–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
আরো পড়ুন …
- সহজ বাটিশাক চাষ পদ্ধতি
- সঠিক বাদাম চাষ পদ্ধতি
- মাশরুম চাষ করুন, ঘরে বসে খুব সহজেই!
- মিষ্টি আলু চাষ পদ্ধতি
- মেটে আলু চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা
- সঠিক আলু চাষ পদ্ধতি জেনে নিন
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।