কৃষি কথা

জেনে নিন উন্নত সরিষা চাষ পদ্ধতি

জেনে নিন উন্নত সরিষা চাষ পদ্ধতি

প্রতি বছরই বাড়ছে সরিষা চাষ । দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় এখন চাষাবাদ হচ্ছে শীতকালের জনপ্রিয় ফসল হল সরিষা। অপেক্ষাকৃত কম খরচ ও পরিশ্রমে দ্রুত ফলন পাওয়া যায়।

তাই সরিষার চাষাবাদে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের।

তবে নিয়ম মেনে চাষাবাদের পাশাপাশি, রোগবালাই দমন ব্যবস্থা জানা থাকলে সহজে সাফল্য মিলে সরিষা চাষে। এই ফসলের চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এই নিবন্ধে।

সঠিক সরিষা চাষ পদ্ধতি

বাংলাদেশে প্রধানত ৩ প্রকার (টরি, শ্বেত ও রাই) সরিষার চাষাবাদ হয়। এছাড়া বর্তমানে নেপাস সরিষার চাষাবাদও হচ্ছে।

বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির জো অবস্থা অনুসারে দেশের উত্তরাঞ্চলও দক্ষিণাঞ্চলে যথাক্রমে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সরিষার বীজ বুনতে হয়।

দেশের মধ্যাঞ্চলে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে বীজ বুনতে হয়। নেপাস জাতের সরিষা মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত বপন করা যায়।

মাটির ধরন ও জমি তৈরি

বিভিন্ন জাতের সরিষার চাষ পদ্ধতি অনেকটা একই। সুনিষ্কাশিত উর্বর ও মধ্য উর্বর দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটি সরিষা চাষের জন্যে উত্তম। এছাড়া…

উচ্চফলনশীল সরিষা বীজ

উচ্চফলনশীল সরিষা বীজ

  • মাটির বর্ণ গাঢ় ধূসর হওয়া ভালো, কারণ লালমাটি বা কাঁকড়যুক্ত মাটি এবং লোনা মাটিতে সরিষার চাষাবাদ ভালো হয় না।
  • মাটির অম্লমান ৬.০ থেকে ৭.০ এর মধ্যে থাকলে উত্তম।
  • উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি সরিষা চাষের জন্যে ভালো; উঁচু-নিচু জমিতে সরিষার চাষ করা যায় না।
  • জমি উন্মুক্ত স্থানে হওয়া দরকার, যাতে সেখানে সারাদিন রোদ পড়ে।

সরিষা চাষের জমিতে ৪-৬টি চাষ ও মই দিয়ে তৈরি করতে হবে (মাটিতে ঢেলা থাকবে না, মাটি সমতল হবে)। মাটি ঝুরঝুরে না হলে বীজ অঙ্কুরোদগম কম হতে পারে। এছাড়া…

  • জমি চাষ করর সময় আগাছা ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
  • যাতে ফসলে আগাছার প্রকোপ কম হয়৷
  • সরিষা জমির চাষ ১০-১২ সেন্টিমিটার গভীরে হওয়া দরকার।
  • বীজ বোনার সময় জমিতে প্রয়োজনীয় রস না থাকলে, জমিতে সেচ দিতে হবে।
  • এরপর বীজ শোধন করতে হবে কৃষকদের।

বীজ হার ও বপন পদ্ধতি

সাধারণত সরিষার বীজ ছিটিয়ে বোনা হয়। তবে সারিতে বীজ বোনলে পরিচর্যা করতে ( সার, সেচ ও নিড়ানী দিতে) সুবিধা হয়। অবশ্য সারিতে বীজ বুনতে কিছু অতিরিক্ত ব্যয় হয়।

সরিষার চাষাবাদে লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব হবে ১ ফুট। আর সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫-৩০ সেন্টিমিটার। প্রতি হেক্টর ৭-৮ কেজি, গাছ সংখ্যা প্রতি বর্গমিটারে ৪৫ থেকে ৬৫টি (গাছের ধরন অনুসারে)।

বীজ বপনের পূর্বে ভিটাভেক্স-২০০ অথবা ক্যান্টন দিয়ে (২-৩ গ্রাম ছত্রাক নাশক/ কেজি বীজ) বীজ শোধন করে বপন করতে হবে। বিনা সরিষার বীজ ব্যাভিষ্টিন (২.৫ গ্রাম/ কেজি) বা বেনলেট (১.৫ গ্রাম/ কেজি) দিয়ে শোধন করতে হবে৷

  • বর্ষাকালে প্রধানত বোনা আমন ও রোপা আমনের জমিতে শীতকালীন ফসল হিসেবে সরিষার চাষ করা হয়। এছাড়া আন্তঃফসল হিসেবে উর্বর জমিতে এবং ফল বাগানে সরিষার চাষ করা যায়৷

সার পরিমাণ ও প্রয়োগ পদ্ধতি

সরিষার চাষাবাদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যতাযত নিয়মে সার প্রয়োগ করা। জাত, মাটি এবং মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে সার দিতে হয়।

ইউরিয়া সার অর্ধেক বপনের আগে এবং বাকি অর্ধেক গাছে ফুল আসার সময় উপরিপ্রয়োগ করতে হয়।

সারের পরিমাণ নিম্নরূপ (হেক্টর প্রতি)

সোনালী (এসএ-৭৫), (বারিসরিষা- ৬,বারি সরিষা-৭, বারি সরিষা-৮) চাষে…

  • ইউরিয়া ২৫০-৩০০ কেজি,
  • টিএসপি ১৭০-১৮০ কেজি,
  • এমপি ৮৫-১০০ কেজি,
  • জিপসাম ১৫০-১৮০ কেজি,
  • জিঙ্ক সালফেট ০ – ৫ কেজি,
  • বোরিক এসিড ১-১.৫ কেজি,
  • ডলোচুন ৪০০ কেজি,
  • সুষম কম্পোষ্ট ২-৩ টন,
  • সাধারণ গোবর ৮-১০ টন,
  • খৈল ১-২ টন

এছাড়া টরি-৭, কল্যাণীয়া (টিএস-৭২) (রাই-৫ দৌলত, আর এস-৮১) চাষে…

  • ইউরিয়া ২০০-২৫০ কেজি,
  • টিএসপি ১৫০-১৭০ কেজি,
  • এমপি ৭০-৮০ কেজি,
  • জিপসাম ১২০-১৫০ কেজি,
  • জিঙ্ক সালফেট ০ – ৫ কেজি,
  • বোরিক এসিড ১-১.৫ কেজি,
  • ডলোচুন ৩০০ কেজি,
  • সুষম কম্পোষ্ট ১-২ টন,
  • সাধারণ গোবর ৬-৮ টন,
  • খৈল ১ টন

উল্লেখ্য, শেষ চাষের আগে প্রতি হেক্টরে ১০ টন জৈবসার ভালোভাবে মাটিতে মিশিয়ে নিতে হবে। বীজ বপন করার ৩০-৪৬ দিন পর নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাশ নির্দিষ্ট অনুপাতে প্রয়োগ করতে হবে। সার উপরি-প্রয়োগের সময় মাটিতে রস থাকা বাঞ্ছনীয়৷

সেচ প্রয়োগ ও পরিচর্যা

সরিষা ক্ষেতে আগাছা দমনে বীজ বোনার ১৫ থেকে ২০ দিন পর ১ বার এবং ফুল আসার সময় দ্বিতীয়বার নিড়ানি দিতে হবে।

এছাড়া বীজ বোনার ২৫ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে (গাছে ফুল আসার সময়) প্রথম সেচ এর ৫০ থেকে ৫৫ দিনের মধ্যে (ফল ধরার সময়) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে।

বীজ বোনার সময় মাটিতে রস কম থাকলে চারা গজানোর ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে একটি হালকা সেচ দিতে হয়।

ভারী মাটি হলে, সেচের আগে চাপান সার দিতে হবে। অপরদিকে হালকা মাটির ক্ষেত্রে সেচের পর পনি থিতিয়ে গেলে এই সার দিতে হবে।

রোগবালাই – পোকা আক্রমণ ও প্রতিকার

সরিষা ক্ষেতের উল্লেখযোগ্য রোগ হলো সাদা মরিচা রোগ, শিকড় ফোলা রোগ, সরিষার ফলে ধ্বসা রোগ, গাছের ধ্বসা রোগ।

এরমধ্যে প্রধান রোগ ধ্বসা রোগ, যার ফলে সরিষার ফলন কমে যায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা।

এছাড়া জাব পোকা, করাত মাছির লার্ভা, হীরক পিঠ মথ প্রভৃতি ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণে সরিষার ফলন অনেক কমে যায় ( ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে)।

প্রতিকারের উপায়

  • মূলত বিভিন্ন ধরনের রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে সরষে গাছকে রক্ষা করার জন্য গাছে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ বা কীটনাশক স্প্রে করা হয়ে থাকে। এছাড়া…
  •  ধ্বসা রোগের ক্ষেত্রে আইপ্রোডায়ন প্রতি লিটার জলে ১ গ্রাম বা মেটালাক্সিল ও ম্যানকোজেব এর মিশ্রণ লিটার প্রতি জলে ২.৫ গ্রাম মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে।
  • এছাড়া শিকড় ফোলা রোগের ক্ষেত্রে বীজ বোনার ১ মাস আগে জমিতে চুন ছিটাতে হবে।
  • পোকামাকড়ের আক্রমণের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে ডাইমিথয়েট বা থায়ামেথক্সাম কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
  • সে ক্ষেত্রে ডাইমিথয়েট প্রতি লিটার জলে ২ মিলি মেশাতে হবে এবং থায়ামেথক্সামের ক্ষেত্রে ১/৩ গ্রাম হারে মেশাতে হবে। ভালো করে এই মিশ্রণ তৈরি করার পর সরষে গাছের ওপর স্প্রে করতে হবে।
ফলন ও ফসল সংগ্রহ

সরিষার ফলন জাত ও ব্যবস্থাপনাভেদে হেক্টরপ্রতি ৬০০-১৫০০ কেজি হতে পারে।  সকালে ফসল তুলতে হয়৷ ফসল সংগ্রহের জন্যে গাছ শিকড়সহ টেনে তোলা বা কাঁচি দিয়ে গাছ মাটির সমানে কেটেও নেওয়া যায়।

ফসল তুলে তা কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে গরু বা লাঠি দিয়ে টিটিয়ে মাড়াই করতে হয়।

–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।  বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *