সাম্মাম বা রকমেলন চাষ পদ্ধতি

সুস্বাদু ও উচ্চ ফলনশীল রকমেলন চাষ পদ্ধতি বাংলাদেশের অনেকেরই জানা নেই। কারণ এদেশে রকমেলন নতুন একটি ফল।

Cantaloupe (ফুটি) বা রকমেলনের আরো কিছু নাম সুইট মেলন, মাস্ক মেলন, হানী ডিউ এবং আরবিতে অনেক দেশে সাম্মাম ও বলে থাকে।

জাপানের জনপ্রিয় এই ফল আমাদের দেশেও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

তাই ইদানিং রকমেলন চাষাবাদে আগ্রহী বাড়লেও চাষ পদ্ধতি না জানার কারণে চাষ করতে পারেন না। চলুন এই নিবন্ধে রকমেলনের চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।

সঠিক রকমেলন চাষ পদ্ধতি

রকমেলনের চাষাবাদে জন্য সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ মাটি উপযুক্ত। তবে উচ্চ লবণাক্ত ক্ষারীয় মাটি রকমেলন চাষের জন্য উত্তম নয়।

চাষের সময় ও জমি প্রস্তুতি

সাধারণত রকমেলনের হানি জুস জাতটি ২ বার চাষ করা যায়।

  • প্রথমবার শীত চলে যাওয়ার পর মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ (ফালগুন) মাসে।
  • দ্বিতীয়বার তাপমাত্রা কমে গেলে মধ্য জুন- মধ্য সেপ্টেম্বর (আষাঢ়-ভাদ্র) মাসে।

 এছাড়া সারা বছরেই গ্রিন হাউজে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করেও রকমেলন চাষ করা যায়।

রকমেলন চাষের জমি ৪-৫ বার চাষ ও মাই দিয়ে ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।

জমি প্রথমে চাষ দেওয়ার পর বিঘা প্রতি ৫ টন গোবর সার ও প্রায় ২৫০ কেজি জিপসাম প্রয়োগ করে পুনরায় চাষ দিয়ে ২ সপ্তাহ ফেলে রাখতে হবে।

বেড তৈরি ও মালচিং পদ্ধতি

  • গোবর সার ও জিপসাম দেয়ার ১৫ দিন পর আবার চাষ দিতে হবে।

    নুসাইবা ১ রকমেলন বীজ
    নুসাইবা ১ রকমেলন বীজ
  • প্রথমে ক্ষেতের চারপাশে ১ ফুট চওড়া নালা রাখতে হবে।
  • বেড হবে ৩.৫ ফিট চওড়া ও আধা থেকে ১ ফিট উচা।
  • দুই বেডের মাঝে নালা থাকবে ২ ফিট চওড়া।

এছাড়া, মালচিং পদ্ধতিতে রকমেলন চাষ করতে মালচিং শিট বেড তৈরির পর বিছাতে হবে।

  • রকমেলন করতে বিঘায় ২ টি মালচিং শিট প্রয়োজন যেগুলো ১.২ মিটার বা প্রায় ৪ ফিট চওড়া ও ৪০০ মিটার বা প্রায় ১৩০০ ফিট লম্বা।
  • ১৬ সাইজের গুনা ৯-১০ ইঞ্চি করে কেটে দুই পাশ বাঁকিয়ে মালচিং পেপারের দুই সাইডে মাটির সাথে গেঁথে দিতে হবে।
  • মাঝে মাঝে পেপারে অল্প মাটি তুলে দিতে হবে যাতে বাতাসে উড়ে না যায়।
  • এরপর শাটারের ¯স্প্রিং ৪ ইঞ্চি ডায়াতে গোল করে ঝালাই করে রড লাগিয়ে কাটার তৈরি করে মালচিং পেপার ছিদ্র করতে হবে।
  • এক মালচিং এর মাঝ বরাবর দুই সারিতে চারা লাগানোর জন্য ছিদ্র করতে হবে।
  • চারা থেকে চারার দুরত্ব ২ ফিট। সারি থেকে সারির দুরত্ব ২ ফিট।

সার প্রয়োগ

রকমেলন চাষাবাদের জমি তৈরির সময় জৈবসার এবং জৈব উপাদান ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে আপনার মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমানে নাট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং সালফার এর উপস্থিতি আছে কিনা।

প্রয়োজনে সার প্রয়োগের আগে মাটি পরীক্ষা করতে হবে। ছাঁদে চাষাবাদের ক্ষেত্রে ভার্মি কম্পোষ্ট প্রয়োগের পাশসাপাশি ফসফেট, ফসফরাস ও সালফার আছে এমন মিশ্র সার প্রয়োগ করা উত্তম।

  • গোবর সার প্রতি বিঘায় ৫ টন, প্রতি গাছে ৬ কেজি
  • জিপসাম / চুন প্রতি বিঘায় ২৪০ কেজি, প্রতি গাছে ১০০ গ্রাম
  • ইউরিয়া প্রতি বিঘায় ১০ কেজি, প্রতি গাছে ৫ গ্রাম
  • টি এস পি প্রতি বিঘায় ৩০-৩৫ কেজি, প্রতি গাছে ১৫ গ্রাম
  • পটাশ / এমওপি প্রতি বিঘায় ৫০ কেজি, প্রতি গাছে ২০ গ্রাম
  • জিংক (গ্রোজিন) প্রতি বিঘায় ২ কেজি , প্রতি গাছে ১ চা চামচ
  • বোরন প্রতি বিঘায় ১.৫ কেজি, প্রতি গাছে ১ চা চামচ
  • ম্যাগনেসিয়াম সালফেট/ ম্যাগসার প্রতি বিঘায় ১২০ কেজি, প্রতি গাছে ৫০ গ্রাম
  • সালফার (থিওভিট) প্রতি বিঘায় ২ কেজি , প্রতি গাছে ১ চা চামচ
  • রিজেন্ট (অটোক্রপ) প্রতি বিঘায় ১.৫ কেজি, প্রতি গাছে১ চা চামচ
  • রাগবি প্রতি বিঘায় ১.৫ কেজি , প্রতি গাছে ১ চা চামচ

মাটির পি এইচ ৬ এর নিচে হলেই কেবল শতক প্রতি ৪ কেজি চুন দিতে হবে। তাহলে, বাকি টুকু হবে (৩.৫) কেজি জিপসাম দিলেই হবে। মাটিতে চুন দিলে আর ম্যাগসার দেয়ার প্রয়োজন নেই।

চারা তৈরি ও চারা বপন

রকমেলনের চারা তৈরি ও চারা রোপন করতে হবে …

  • প্রথমে বীজ কয়েক ঘণ্টা রোঁদে শুকিয়ে নেওয়া উত্তম।
  • শুকানো বীজ এক ঘন্টা ছায়ায় রেখে ঠান্ডা করে নিতে হবে।
  • শোধনের জন্য পানির সাথে ছত্রাক নাশক মিশিয়ে বীজ ২০ মিনিট ভিজিয়ে নিতে হবে।
  • এরপর ধুয়ে আরো ৩-৪ ঘন্টা শুধু পানিতে ভিজিয়ে নিতে হবে।
  • বীজ উঠিয়ে ঝেড়ে সীড ট্রে তে দিতে হবে।
  • বীজ দেয়ার পর ভালোভাবে পানি স্প্রে করে দুই-একদিন ট্রে ঢেকে রাখলে দ্রুত অঙ্কুরোদগম হবে।
  • এরপর চারার ট্রে রোদে রাখতে হবে।
  • পলি টানেলের ভিতরে রাখলে কুয়াশা ও বৃষ্টির হাত থেকে চারা রক্ষা পাবে।
  • সর্বদা ট্রে স্প্রে করে ভিজিয়ে রাখতে হবে যাতে কখনো মাটি শুকিয়ে না যায়।
  • চারার বয়স ১০-১২ দিন হলে অর্থাৎ বীজ পাতার পর দুই-আড়াই পাতা হলে জমিতে দিতে হবে।
  • এর আগে জমি প্রস্তুত করে নিতে হবে।
  • ট্রে থেকে চারা তুলে ছিদ্রে গর্ত করে বপন করতে হবে।
  • এরপর ২ দিনের মাঝে আড়াআড়ি ক্রস করে প্রায় ৬ ফিট লম্বা কঞ্চি প্রতি গর্তে স্থাপন করতে হবে।
  • ক্রস সেকশন গুনা দিয়ে বেঁধে গুনার দুই প্রান্তে বেডের দুই মাথায় মোটা বাঁশ স্থাপন করে আটকে দিতে হবে।
  • প্রয়োজনে সাপোর্টের জন্য বেডের মাঝে আরো কিছু বাঁশ দিতে হবে।
  • চারা স্থাপনের পর ক্ষেতে পানি সেচ দিতে হবে।
  • বেড বেশি উঁচা হলে পাত্র দিয়ে পানি গাছের গোড়ায় দিয়ে দিতে হবে।
  • এছাড়া প্রয়োজন অনুসারে বালাইনাশক ও সার স্প্রে করতে হবে।

টবে বা ছাঁদে বাগানের ক্ষেত্রে- ১০ – ১২ ইঞ্চি টবে বা এমন মাপের যে কোন পাত্রে ২ টি অর্ধ ইঞ্চি মাটির নিচে এই বীজ বপন করতে হবে। মাটি পরিমানে কম হলেও এর মধ্যে যথেষ্ট পরিমান জৈবসার এবং জৈব উপাদান বিদ্যমান থাকতে হবে।

পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন

ফল ধরে গেলে নন-অভেন (NWF) টিস্যু ব্যাগ দিয়ে ব্যাগিং করলে মাছি পোকা ও কাটুই পোকা থেকে ফল ভালো থাকে। এছাড়াও…

এফিড এবং থ্রিপসঃ  এগুলি পাতা থেকে রস আদ্বাদন করে। ফলে পাতা হলুদ হয়ে যায় এবং ঝরে পড়ে।

থ্রিপসের ফলে পাতা কুঁকড়ে যায়, পাতা কাপ আকারের হয় বা উর্ধ্বমুখী বাঁকা হয়।

এপোকা দমনে থায়ামেথক্সাম ব্যবহার করতে পারেন। যদি পাউডারী / ডাউনি মিলডিউয়ের আক্রমণ দেখা যায় তবে থায়ামেথক্সাম দিয়ে প্রথমে প্রে করে নি এবং ১৫ দিন পরে ডাইমেথয়েট  + ট্রাইডেমরফ স্প্রে করতে হবে।

লিফ মাইনারঃ এপোকা পাতায় খায়ে পাতাকে সর্পিলাকার সুড়ঙ্গে পরিণত করে। এটি সালোকসংশ্লেষণ এবং ফলের গঠনকে প্রভাবিত করে।  এপোকা দমনে অ্যাবামেকটিন স্প্রে করুন।

ফলের মাছি পোকাঃ এটি একটি মারাত্মক পোকা। স্ত্রী পোকা তরুণ ফলের এপিডার্মিসের নীচে ডিম পাড়ে। পরে লার্ভা ফলের পাল্প খাওয়া শুরু করলে ফলে পচা শুরু হয়।

এপোকা দমনে ম্যালাথিয়ন পানিতে মিশিয়ে ৩ থেকে ৪ বার স্প্রে করে নিন।

পাউডারি মিলডিউঃ পাতলা, সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো অংশবিশেষ পাতার উপরের পৃষ্ঠ এবং সংক্রামিত গাছের মূল কাণ্ডে প্রদর্শিত হয়।

মারাত্মক আক্রমণের ফলে এটি ডিফলিয়েশন এবং অকাল ফলের পাকার মত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

এরোগ দমনে পানিতে দ্রবণীয় সালফার  মিশিয়ে স্প্রে করে নিন (১০ দিনের ব্যবধানে ২-৩ বার ব্যবহার করুন)।

সাডেন উইল্টঃ এটি যে কোনও পর্যায়ে ফসলের ক্ষতি করতে পারে। স্বল্প আক্রমণের ফলে উদ্ভিদ দুর্বল হয়ে যায় এবং হলুদ বর্ণ ধারণ করে, মারাত্মক উপদ্রব গাছা নির্জীব হয়ে যায়।

এরোগ দমনে  জমিতে জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।। ক্ষেত থেকে দূরে নিয়ে সংক্রমিত অংশগুলি ধ্বংস করুন। এছাড়া  কার্বেনডাজিম বা থিওফ্যানেট-মিথাইল পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করুন।

সেচ ও পরিচর্যা

গ্রীষ্মের মৌসুমে চারা বপনের পর ২-৩ দিন অন্তর অন্তর হালকা সেচ দিতে হবে। তবে কোন অবস্থাতেই এমন ভাবে সেচ দেয়া যাবে না চারা পানি জমে থাকে।

ফুল আসার সাথে সাথে ১ দিন পর পর সেচ দেওয়া উত্তম। তবে ভারী জমিতে ঘন ঘন সেচ এড়িয়ে চলুন।

ভাল মিষ্টি এবং স্বাদের জন্য, ফসল তোলার ৩-৬ দিন পূর্বে সেচ দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

যেহতু রকমেলন একটি লতা জাতীয় গাছ এবং এর লতা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় তাই এর লতা ধারণের জন্য অতিরিক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে (মাচা পদ্ধতি ও মাটিতে খড়কুটো বিছিয়ে দিয়ে)।

এছাড়া রকমেলন ক্ষেতের জমি আগাছা মুক্ত রাখুন। সঠিক পরিচর্যা অভাবে ৩০ ভাগ ফলন হ্রাস করতে পারে। বপনের ১৫ থেকে ২০ দিন পর পর আগাছা পরিস্কার করতে হবে।

কাটিং রকমেলন চাষে খুব গুরুত্বপূর্ণ। গাছের নিচের দিকে কেবল একটি ডাল রেখে বাকি গুলো ফেলে দিতে হবে।

গাছ ৭-৮ পাতা হলে আগা কেটে দিতে হবে। এরপর দুই শাখা বের হবে।

সেখানে গাছের প্রথম পাতা (বীজ পাতা বাদে) থেকে হিসাব করে ৮ম-১২তম পাতার গোড়ায় আসা ফল পরাগায়ন করে নিতে হবে।

এরপর ফল ১৫০-২০০ গ্রাম হলে একটি গাছে প্রতি ডালে একটি করে মোট ২টি ফল রাখতে হবে। এর বেশি ফল রাখা যাবে না।

ফলন ও ফসল সংগ্রহ

সঠিকভাবে চাষাবাদ এবং নিয়মিত ফুলের পরাগায়নে একটি রকমেলন গাছে ৮-১২ টি ফলল পাওয়া যাতে পারে। ফল হলুদ হয়ে এলে ফসল তোলা শুরু করতে হবে।

–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।  বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?