পান চাষ, জেনে নিন চাষাবাদ পদ্ধতি ও পরিচর্যা

আমাদের দেশের মাটি ও প্রকৃতি পান চাষ করার উপযোগী। অন্যদিকে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এখন বাণিজ্যিকভাবে পানের চাষাবাদ করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা।

ফলন ভালো ও লাভজনক হওয়ায় পান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা; এতে দিন দিন বাড়ছে পানের বরজের সংখ্যা।

তাই আজ আমরা পান চাষিদের জন্য সঠিক ও উন্নত পান চাষ পদ্ধতি, পরিচর্যা ও বোগ বালাই দমনের বিভিন্ন দিক নিয়ে এই নিবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করব।

যেভাবে বাণিজ্যিকভাবে পান চাষ করবেন

পানের বরোজ তৈরি বা চাষের জন্য দরকার উঁচু, বন্যামুক্ত, সুনিষ্কাশিত বেলে দোআঁশ বা এটেল দোআঁশযুক্ত মাটি ছায়াযুক্ত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া পান চাষের জন্য ভাল)।

মাটির পি. এইচ. (অম্লত্ব বা ক্ষারত্ব) এর মান ৭ এর কাছাকাছি হওয়া উচিত।

বরোজ জমির তল বা প্লেট চারপাশের জমির তল থেকে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ সেমি উঁচু হতে হবে। মূলত বর্ষাকালীন সময় বা আষাঢ় মাসে পানের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।

জমি তৈরী

  • পানের বরোজ তৈরির জমিতে প্রচুর পমিাণে জৈব সার (কম্পোস্ট, খইল) প্রয়োগ করে ৩-৪ বার চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে মাটির সাথে মিশেয়ে দিতে হবে।
  • এর পরে বরোজের জমির তল বা প্লেট পিটিয়ে শক্ত করতে হবে।
  • সাদা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে প্লেট কমপক্ষে একমাস ঢেকে রাখতে হবে।
  • তবে ১৫ দিন পর পলিথিন তুলে ৪০ শতাংশ ফরমালিনের দ্রবণ প্রয়োগ করে ফের পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
  • ১০ দিন পর ফের একই ভাবে পলিথিন তুলে ফরমালিন পানি দিয়ে প্লেট ভিজিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
  • এর ৫-১০ দিন পর ঐ জমিতে ভাটি/মাদা/পিলি তৈরী করে চারা লাগানো যাবে।
  • পানের বরোজ যে মাটি দেওয়া হবে, সেই মাটি তুলে এক জায়গায় জমা করে রাখতে হবে এবং একইভাবে ফরমালিন ও পলিথিন দিয়ে শোধন করে নিতে হবে।

বপন পদ্ধতি

  • বরজের উচ্চতা ২ মিটার অর্থাৎ ৬ ফুট এর কাছাকাছি হতে হবে।
  • পানের বরোজের জমিকে আগাছামুক্ত, সমতল ও উঁচু করে তৈরি করে প্রতি ৬০ সে.মি অন্তর অন্তর ২০ সে.মি চওড়া করে নালা তৈরি করতে হবে।
  • বরোজের বাইরে একটি বড় নিকাশ নালার সাথে ছোট নালাগুলোকে যুক্ত করে দিতে হয়।
  • কাটিং সামান্য কাৎ করে (৪৫ ডিগ্রী) অর্ধেক অংশ মাটির ভেতর এবং বাকি অংশ চোখ বা মুকুল মাটির ওপর রাখা হয়।
  • দ্বিসারি পদ্ধতিতে ৩-৬ ইঞ্চি লম্বা কাটিং লাগে শতক প্রতি ৪০০-৫০০ টি।
  • বরোজের ভেতরে চারিদিকে ২৫ ইঞ্চি চওড়া রাস্তা রাখতে হয়।
  • প্রতিটি বেড ৫০ ইঞ্চি চওড়া করে তৈরি করা উত্তম।
  • প্রতিটি বেডে দুই লাইনে চারা বপন করতে হবে।
  • একলাইন থেকে আরেক লাইনের দূরত্ব হবে ১২থেক ১৫ ইঞ্চি।
  • আবার প্রতি দুই বেডের মাঝখানে ১২ ইঞ্চি নালা রাখা দরকার।

 “মা” গাছ নির্বাচন, শোধন ও চারা সংগ্রহ

পছন্দ মত জাত নির্বাচন করে স্থানীয় কোন বরোজ থেকে চারা সংগ্রহ করা উচিত। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে সংগ্রহকৃত চারা বা লতা যেন রোগমুক্ত (বিশেষ করে আঙ্গারী) সুস্থ, সবল, সতেজ, ৪-৫ বৎসরের পুরানো পান গাছের হয়।

এছাড়াও…

  • মা গাছ নির্বাচনের পর চারা কাটার ৭-১০ দিন আগে মা গাছে ঔষধ প্রয়োগ করা উত্তম।
  • তবে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে ২ বার ঔষধ প্রয়োগ করতে পারলে ভালো।
  • পানের চারা সংগ্রহের ৫- ৬ দিন আগে গাছের ডগার দিকে ২-৩ সেমি ভেঙে দিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
  • গাছের ওপরকার ১ মিটারের মধ্য থেকেই চারা সংগ্রহ করতে হবে।
  • ২-৩টি গাঁটযুক্ত পানের লতা তেরছা (কলস কাট) ভাবে কেটে সংগ্রহ করতে হবে।
  • ধারালো কাস্তে, ব্লেড বা ছুরি ডেটল, স্পিরিট বা আগুনে শোধন করে চারা কাটা উত্তম।

চারা বা  লতা শোধনের জন্য জীবাণু ঘটিত ঔষধে ২৫-৩০ মিনিট চুবিয়ে নিতে হবে। এর পর ছায়াতে শুকিয়ে চারাগুলিকে শিকড় বৃদ্ধিকারক হরমোন  ৪-৫ মিনিট চুবিয়ে ছায়াতে শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর উক্ত চারাগুলিকে ভাটিতে বা পিলিতে লাগাতে হবে।

সার ব্যবস্থাপনা

পানের চাষাবাদের জমিতে সব সময় মাটি পরীক্ষার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সার (৪০-৪৫ দিন অন্তর অন্তর)  প্রয়োগ করতে হবে। যেমন তিলের খৈল বা নিম তৈল, টিএসপি, এমওপি, ইউরিয়া ও এসএসপি।

প্রাথমিক ভাবে জমি তৈরির সময় শেষ চাষের পর মাটিতে একর প্রতি…

  • ২০০ কেজি তিলের খৈল বা নিম তৈল,
  • ৪০ কেজি টিএসপি ও ৬০ কেজি এমওপি সার মিশিয়ে দেয়া দরকার।

এছাড়া পরবর্তিতে প্রতি শতক জমির জন্য…

  • খৈল ২০ কেজি,
  • ২.৫ কেজি এসএসপি,
  • ৬০০ গ্রাম এমওপি এবং ১.৮ কেজি ইউরিয়া সার সমান চার ভাগ করে বছরে ৪ বার পান ক্ষেতে প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ ও পরিচর্যা

নিয়মিত পানের বরোজে পরিমিত সেচ দিতে হবে এবং চারা রোপণের পর ঝাঝরি দিয়ে হালকা সেচ দেওয়া উত্তম।  এছাড়া…

  • পান ক্ষেতে ভাসিয়ে সেচ দেওয়া যাবে না।
  • কলসি, টিন কিংবা সরু পাইপ দিয়ে হাল্কা সেচ দিতে হবে।
  • গ্রীষ্মকালে প্রতি দিনই হাল্কা সেচ দিতে হবে।
  • সেচ দেওয়ার সময় খেয়াল লক্ষ্য হবে যেন মাটি পাতাতে ছিটকে না লাগে, না হলে পাতায় রোগাক্রমণ হতে পারে।
  • প্রচন্ড রোদ যাতে না লাগে তার জন্য প্রয়োজনীয় ছাউনির ব্যবস্থা করতে হবে।
  •  না হলে পাতা ফ্যাকাসে বা সাদাটে হয়ে যাবে।
  •  তবে বর্ষাকাল ও শীতকালে যাতে হাল্কা রোদ লাগে তার জন্য ছাউনি কমাতে হবে।
  • কিন্তু ঠাণ্ডা বাতাস, কুয়াশা, ঝোড়ো হাওয়া যাতে গাছে না লাগে এদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • এর জন্য পান ক্ষেতে ভালো করে বেড়া দিতে হয়।
  • পানের লতা নামানোর আগে গোড়ার দিকের পাশ ভেঙ্গে নিতে হবে।
  • যাতে পাতা মাটিতে না লাগে; নতুবা রোগের আক্রমণ হতে পারে।
  • রোগাক্রমণ যাতে না হয় সেজন্য লতা নামানোর ঠিক আগে একটি ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
  • যথা রাসায়নিক ঔষধ ০.৫ শতাংশ বোর্দোমিশ্রণ বা কোন কপার ঘটিত ঔষধ স্প্রে করতে হবে।
  • ভাটিতে বা পিলিতে বা চলার রাস্তাতে (দুটি ভাটির মাঝখানে) দেওয়ার মাটি আগে তুলে শোধন করে নিতে হবে।
  • ভাজ দেওয়ার সময় লতা যেন আলগা না থাকে।
  • মাটি দিয়ে ভাল করে ঢেকে দিতে হবে।
  • ভাঁজ দেওয়ার সময়ও রাসায়নিক সার মিশ্রিত জৈব সার ভাটিতে দেওয়া হয়।
  • এই ভাঁজ সাধারণত ৬০-৭৫ দিন অন্তর দেওয়া হয়।

সাধরাণত বছরে  ২ বার (১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল এবং ১৫ জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর) পানের লতা নামানো হয়। গাছের বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে লতা নামাতে হবে; বৃদ্ধি বেশি হলে ঘনঘন নামাতে হবে।

পোকামাকড় -রোগবালাই দমন  ও প্রতিকার

পান ক্ষেতে নানাবিধ রোগের কারনে পানের গুনগত মান নষ্ট হয় ও ফলন হ্রাস পায়। কাজেই পানের রোগের কারন ও প্রতিকার জানা থাকা উচিত।

গোড়া পঁচা: এই রোগ এক ধরণের ছত্রাকের আক্রমণে হয়।

  • বোঁর্দে মিশ্রণ দিযে মাটি শোধন করলে এই রোগের আক্রমণ কম হয়।
  • এই রোগের আক্রমণ বেশি হলে ডায়থেন এম-৪৫ বা রিডোমিল গোল্ড/ফলিও গোল্ড ছত্রাক নাশক মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

পাতা পচা রোগ: এই রোগের কারণে পান পাতা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আক্রান্ত পাতার বিভিন্ন জায়গায় কালো বা বাদামী রঙের ভেজা ভেজা পচা দাগ দেখা যায়।

  • তারপর এই দাগ দ্রুত পাতার বেশীর ভাগ অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
  • মাঝে মাঝে পাতার আক্রন্ত অংশের মাঝে চক্রাকার ঢেউ খেলানো, হালকা রঙের দাগ দেখা যায়।
  • এই রোগের অয়ারেক নাম ফোস্কা।
  • বর্ষাকালে এর প্রকোপ বাড়লেও শীত আসলে তা কমে যায়।

এই রোগ প্রতিরোধের জন্য বর্ষার আগে থেকে ০.৫% বোর্দু মিশ্রণ ১৫ দিন অন্তর অন্তর পাতার উভয় দিকে ও ডাটায় ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে। পরিবর্তে ব্লাইটক্স, ফ্লাইটোলান প্রতি লিটার জলে ৪ গ্রাম হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

পাতায় দাগ রোগ: এই রোগে অক্রান্ত পান পাতার দাম অনেক কমে যায়। বর্ষার শুরুতে এই রোগের প্রকোপ বাড়লেও  শীত আসলে তা কমে যায়।

বর্ষার শুরু ০.৫% বোদু মিশ্রন ৩-৪ বার ১৫-২০ দিন অন্তর অন্তর গাছের ডাটায় ও পাতার উভয় দিকে স্প্রে করলে রোগে প্রকোপ কমে।

ফসল সংগ্রহ

চারা বপনের ৫-৬ মাস পর থেকেই পান পাতা সংগ্রহ শুরু করা যায়। নিচের পাতা আগে সংগ্রহ করতে হয়।

এছাড়া  লতা নামানোর আগে সংগ্রহ করার যোগ্য সব পান তুলে ফেলতে হবে।

–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।  বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?