নতুন পদ্ধতিতে ড্রাগন ফল চাষ

ইদানিং বাংলাদেশে ড্রাগন ফল চাষ হচ্ছে। ড্রাগন মূলত মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার প্রসিদ্ধ ফল হলেও এটি আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে।

আমাদের দেশীয় উদ্ভাবিত জাত ও থাইল্যান্ডের জাতের ড্রাগন ফলের চাষাবাদে ফলন হচ্ছে প্রায় তিনগুণ।

তাই চাষীরা দিন দিন এর বানিজ্যিক উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছে; আর্থিকভাবেও হচ্ছেন বেশ লাভবান। তাই আজ আমার ড্রাগন ফল চাষ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

কি ভাবে ড্রাগন ফল চাষ করবেন

‘বারি ড্রাগন ফল-১’ এ জাতটি দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়াতে জনপ্রিয় ফল। এটি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সিটিউট (বারি) উদ্ভাবিত ড্রগন ফলের নতুন জাত( মূলত কোস্টারিকা ও পিটাইয়া জাত মিলিয়ে তৈরি)।

এছাড়া বাউ ড্রাগন ফল-১ (সাদা) ,বাউ ড্রাগন ফল-২ ( লাল ), বাউ ড্রাগন ফল-৩ জাতগুলো বাংলাদেশে উদ্ভাবিত।

দেশের সব হর্টিকালচার সেন্টার ও নার্সারীতে ড্রাগন ফলের চারা পাওয়া যায়। তবে বীজ দিয়ে চারা তৈরী চেয়েও কাটিং করে শাখা কলমের মাধ্যমে চারা তৈরী করা উত্তম।

জমি তৈরি ও বপন পদ্ধতি

  • ড্রাগন ফল সাধারণত সারা বছরেই (প্রায় সব ঋতুতেই)  চাষ করা যায়।

    উচ্চফলনশীল ড্রাগন ফল বীজ (হাইব্রিড)
    উচ্চফলনশীল ড্রাগন ফল বীজ (হাইব্রিড)
  • সুনিষ্কাশিত উঁচু ও উর্বর জমিতে ড্রাগনের ফলন ভালো হয়।
  •  ড্রাগন চাষে অর্গানিক ম্যাটার বেশি দিতে হয়, তাহলে ফল খুব দ্রুত বাড়ে।
  • সমতল ভূমিতে বর্গাকার বা ষঢ়ভূজাকার এবং পাহাড়ি ভূমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে ড্রগন ফলের কাটিং রোপণ করতে হবে।
  • এপ্রিল থেকে মধ্য অক্টোবর ড্রগন ফল বপনের জন্য উপযোগী সময়।
  • চারা বপনের আগে ১.৫ মিটার*১.৫ মিটার*১ মিটার আকারের গর্ত করে তা রোদে খোলা রাখতে হবে।
  • গর্ত তৈরীর ২০ থেকে ২৫ দিন পর প্রতিটি গর্তে ২৫ থেকে ৩০ কেজি পচা গোবর, ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ২৫০ গ্রাম এমওপি, ১৫০ গ্রাম জিপসাম এবং ৫০ গ্রাম জিংক সালফেট সার গর্তের মাটির সঙ্গে ভালো ভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে।
  • প্রয়োজনে সেচ দিতে হবে।
  • গর্ত ভরাটের ১০-১৫ দিন পর প্রতি গর্তে ৫০ সেমি দূরত্বে চারটি করে চারা সোজাভাবে মাঝখানে লাগাতে হবে।
  • চারা বপনের এক মাস পর থেকে এক বছর পর্যন্ত প্রতি গর্তে তিন মাস পর পর ১০০ গ্রাম করে ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
  • গাছ লতানো ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার লম্বা হওয়ায় সাপোর্টের জন্য চারটি চারার মাঝে একটি সিমেন্টের চার মিটার লম্বা খুঁটি দিতে হবে।

এরপর খুঁটির মাথাই পুরাতন টায়ার আটকিয়ে গাছের মাথা ও অন্যন্য ডগা টায়ারের ভিতর দিতে বাইরের দিকে ঝুলিয়ে দিতে হবে; এতে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।

সেচ ও পরিচর্যা

সঠিক পরিচর্যা অভাবে ড্রাগন ফল গাছের ফলন তেমন ভালো হয়না। এছাড়া ড্রাগন ফল একদম খরা ও জলাবর্ধতা সয্য করতে পারে না। তাই…

  • শুস্ক মৌসুমে আগাছা পরিস্কার করে ১০-১৫ দিন অন্তর অন্তর সেচ দিতে হবে।
  • এছাড়া ফলন্ত গাছে ৩ বার ( ফুল ফোটা অবস্থায়, ফল মটর দানা অবস্থায় এবং ১৫ দিন পর) সেচ দিতে হবে।

রোগবালাই ও পোকা মাকড় দমন

ড্রাগন ফলে রোগ বালাই তেমন একটা চোখে পড়ে না। তাবে কখনো কখনো এ গাছে মূলপঁচা, কান্ড ও গোড়া পঁচা রোগ দেখা যায়।

মূলপচা রোগ

  • ড্রাগন ফলের চারা গোড়ায় অতিরিক্ত পানি জমে গেলে মূল পঁচে যায়।
  • এ রোগ হলে মাটির ভিতরে গাছের মূল একটি দুটি করে পঁচতে পঁচতে গাছের সমস্ত মূল পঁচে যায়।
  • গাছকে উপরের দিকে টান দিলে মূল ছাড়া শুধু কান্ড উঠে আসে।
  • তবে এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে উঁচু জমিতে ড্রাগন ফলের চাষ করা ভালো।

কাণ্ড ও গোড়া পচা রোগ

  • ছত্রাক অথবা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ড্রাগন ফল গাছে এ রোগ হতে পারে।
  • এ রোগ হলে গাছের কাণ্ডে প্রথমে হলুদ রং এবং পরে কালো রং ধারণ করে এবং পরবর্তীতে ঐ অংশে পঁচন শুরু হয় এবং পঁচার পরিমাণ বাড়তে থাকে।
  • সহজেই এ রোগ দমনের জন্য যে কোন ছত্রাকনাশক (বেভিস্টিন, রিডোমিল, থিওভিট ইত্যাদি) ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।

এছাড়া, ড্রাগন ফলে মাঝে মাঝে এফিড ও মিলি বাগের আক্রমণ দেখা যায়।

এফিডের বাচ্চা ও পূর্ণ বয়স্ক পোকা গাছের কচি শাখা ও পাতার রস চুষে খায়, ফলে আক্রান্ত গাছের কচি শাখা ও ডগার রং ফ্যাকাশে হয়ে যায় ও গাছ দূর্বল হয়ে পড়ে।

এ পোকা ডগার উপর আঠালো রসের মতো মল ত্যাগ করে ফলে শুটিমোল্ড নামক কালো ছত্রাক রোগের সৃষ্টি হয়।

এতে গাছের খাদ্য তৈরি ব্যাহত হয়। এতে ফুল ও ফল ধারণ কমে যায়।

এ পোকা দমনে সুমিথিয়ন/ডেসিস/ম্যালাথিয়ন এসব কীটনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ মিলিলিটার বা ৫ কাপ ভালো ভাবে মিশিয়ে স্প্রে করে সহজেই এ রোগ দমন করা যায়।

টবে ড্রাগন ফল চাষ

আমাদের দেশের আবহাওয়া ড্রাগন ফল চাষের জন্য উপযুক্ত। তাই আপনি চাইলে ছাদ বাগানে বড় টবে বা ড্রামে এই ফলের চাষ করতে পারেন।

  • ছাদ বাগানে ড্রাগনের চারা প্রায় সব ঋতুতেই বপন করা যায়।
  • কিন্তু ছাদে ড্রাগন ফলের ভালো ফলন পেতে এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাসে চারা বপন করা উত্তম।
  • এই ফল চাষ টবে বা ড্রামে করা যাবে; তবে ২০ ইঞ্চি আকারের ড্রাম বেছে নেওয়া ভালো।
  • কারণ বড় আকারের ড্রামে ফলন অনেক ভালো হয়।
  • সহজেই সব ধরনের মাটিতে ড্রাগন ফলের চাষাবাদ করা যায়।
  • তবে ভালো ফলনের জন্য উৎকৃষ্ট জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ বেলে দোঁআশ মাটিই বাছাই করা উত্তম।
  • বেলে দোআঁশ মাটি ভালোভাবে পরিস্কার করে নিয়ে পরিমাণ মতো গোবর, ৫০ গ্রাম পটাশ সার ও ৫০ গ্রাম টিএসপি সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • সার ও মাটির মিশ্রণে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিতে হবে।
  • তারপর বাছাই করা ড্রামে সব উপকরণ ১০-১২ দিন রেখে দিতে হবে।
  • এরপর ড্রামের মাটি ভালো করে খুন্তি দিয়ে ঝুরঝুরে করে আরো চার থেকে পাঁচদিন রাখতে হবে।
  • মাটি কিছুটা শুষ্ক হয়ে উঠলে ভালো জাতের কাটিং চারা ড্রামে বা টবে বপন করতে হবে।
  • যদিও ড্রাগন ফল গাছে তেমন একটা রোগবালাই ও পোকামকড়ের আক্রমন হয় না।
  • তবে পারিপার্শ্বিক অন্যান্য যত্ন নিয়মিত নিতে হয়।
  • চারা লাগানোর পর ড্রামটি রোদ যুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
  • এছাড়া চারায় পানি দেয়ার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গোড়ায় পানি না জমে।
  • ড্রামের ভেতরের বাড়তি পানি সহজেই অপসারণের জন্য ড্রামের নিচে ছিদ্র করে দিতে হবে।
ফলন ও ফল সংগ্রহ

ড্রাগন ফলের উৎপাদনের পরিমাপ প্রতি হেক্টরে ৩০-৩২ টন। ড্রাগন ফলের কাটিং চারা বপনের ১২-১৮ মাস বয়সে ফল সংগ্রহ করা যায়।

গাছে ফুল আসার মাত্র ৩৫-৪০ দিনের মধ্যেই ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে যায়।

ফল যখন সম্পূর্ণ লাল রঙ ধারণ করলে সংগ্রহ করতে হয়। ড্রাগন ফল সাধারণত মে মাস থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত উৎপাদিত হয়; বছরে ৩-৪ ফল সংগ্রহ করা যায়।

–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।  বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?