আধুনিক পদ্ধতিতে গোলাপ ফুল চাষ

বর্তমানে বছর জুড়ে পুষ্পপ্রেমীদের সবচেয়ে প্রিয় ফুল গোলাপ ফুল চাষ হচ্ছে আমাদের দেশে। সাধারণত কাট ফ্লাওয়ার হিসেবে গোলাপ ফুল বহুলভাবে ব্যবহৃত। আতর ও সুগন্ধি শিল্পেও এই ফুলের ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।

এছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, বাগান, লন, কেয়ারী, বারান্দা সাজাতে গোলাপ ফুলের জুড়ি নেই। আজ আমরা এই নিবন্ধে গোলাপ ফুলের সঠিক চাষ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

বছর জুড়ে যেভাবে গোলাপ ফুল চাষ করবেন

পৃথিবীতে অনেক জাতের গোলাপ আছে; তবে বাংলাদেশে পাপা মেলান্ড, মিরান্ডি, ডাবল ডিলাইট, প্যারাডাইস, তাজমহল, ব্লু-মুন, টাটা সেন্টার, মন্টেজুমা, সিটি অব বেলফাস্ট ইত্যাদি গোলাপের চাষাবাদ হয়।

শীত ও নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলের এই ফুল সুনিষ্কাশিত ঊর্বর দোঁ-আশ মাটির জমিতে ভালো জন্মে। সূর্যের আলোর উপর গোলাপের ফলন ও ফুলের গুনগত মান নির্ভর করে (সকালের রোদ বেশি উপকারী)।

সারা বছর চাষ করা গেলেও আমাদের দেশে অক্টোবর-ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত গোলাপের চারা রোপণের সময় উত্তম সময়।

জমি তৈরি

আলো বাতাসপূর্ণ সমতল জমিতে গোলাপের চাষ ভালো হয়। এই ফুলের চাষাবাদের জমি গভীর ভাবে ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি নরম ও ঝুরঝুরা করে সমতল করে নিতে হবে।

  • এছাড়া জমিতে আগাছা বা অন্য কোন আবর্জনা থাকলে ফেলে দিতে হবে।

    উচ্চফলনশীল গোলাপ ফুল বীজ (হাইব্রিড)
    উচ্চফলনশীল গোলাপ ফুল বীজ (হাইব্রিড)
  • বর্ষাকালের আগে মে-জুন মাসের মধ্যেই বেড তৈরি করা উত্তম।
  • বেড  এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যেন বেডের খৈল ও অন্যান্য জৈব উপাদান ভালো ভাবে পচে অক্টোবর মাসে গাছ লাগানোর উপযোগী হয়ে উঠে।
  • বেডের আশে পাশে যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • উঁচু ও মাঝারি উঁচু ছায়াহীন সেচ সুবিধা আছে এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।
  • গোলাপ চাষের জমি বেশি শুকনো হলে সেচ দিয়ে জো আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
  • মাটির সাথে জৈব সার ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • জমির pH ঠিক রাখার জন্য চুন অথবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সার দিতে হবে।

গোলাপ চাষাবাদের জমি পোকা মাকড়, ক্লোরডেন এবং মাটি বাহিত রোগ থেকে মুক্ত রাখতে শেষ চাষের সময় ব্রোমাইড ক্লোরোপিকরিন (১৬২ কেজি /একর) দিতে হবে।

বংশ বিস্তার

সাধারণত গোলাপ ফুল বীজ, কাটিং, গুটি কলম এবং চোখ কলমের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে। বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তার শুধুমাত্র প্রজনন বা ফসল উন্নয়নের ব্যবহার করা হয়।

  • গোলাপ সাধারনত কলমের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করে থাকে।
  • তবে নতুন গোলাপ গাছ উৎপন্নের অন্যতম পদ্ধতি হল বাডিং বা চোখ কলম।
  • বাণিজ্যিক গোলাপ চাষের জন্য চোখ কলম ব্যবহার করা হয়।
  • এর জন্য বাছাই কৃত জাতটি নিয়ে তার চোখ একটি সুবিধা অনুযায়ী আদি জোড় এর উপর স্থাপন করতে হবে।
  • এই আদি জোড়ের কাটিং গ্রীষ্ম কালের শেষে তৈরি করা হয়ে থাকে।
  • এটি সারি করে লাগাতে হবে; প্রতিটি সারির দূরত্ব থাকে ২৫-৩০ সেমি।
  • প্রায় ৬ মাস পর এই কাটিং থেকে বাডিং এর জন্য উপযোগী চারা তৈরি হয়ে থাকে।

গোলাপ চারা রোপন পদ্ধতি

গোলাপ চারাটি লাগাতে সাধারণত ২০-৩০ সেমি* ২৫ -৩০ সেমি আয়তনের গর্ত তৈরী করে। তারপর গর্তের মধ্যে চারাটি রোপন করতে হবে।

  • গোলাপ প্রধানত চারা পলিথিনের ব্যাগে থাকে।
  • তাই চারা রোপন করার সময় এই পলিথিন ব্যাগটি ছিড়ে ফেলে দিতে হবে।
  • চারা রোপনের সময়  লক্ষ্য রাখতে হবে পলিথিনে রাখা অবস্থায় এটি যতটুকু মাটির নিচে ছিল গর্তে লাগানোর পরে ও ঠিক ততটুকু যেন মাটির নিচে থাকে।
  • চারার গোড়া যেন সোজা থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

গোলাপ গাছ দ্রুত বৃদ্ধির জন্য  গাছ থেকে গাছ দূরত্ব ২ ফুট এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৩ ফুট। কলমের নীচের অংশ হতে কোন ডালপালা না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

সার প্রয়োগ

গোলাপে ভালো ফলন পেতে হলে প্রয়োজনমত সার প্রয়োগ করা জরুরি।

জমি তৈরির সময় প্রতি একরে

  • কাঁচা গোবর ২০০০ কেজি,
  • জৈব সার ৬০০ কেজি,
  • টিএসপি ৫০ কেজি,
  • এমওপি ২০ কেজি,
  • খৈল ১৫০ কেজি,
  • ইউরিয়া ১০০ কেজি (প্রথম বছর) প্রয়োগ করতে হবে।

এছাড়া চারা লাগানোর ২০ -২৫ দিন পর ইউরিয়া ১৫ কেজি,  কুঁড়ি বের হওয়ার পূর্বে দসত্মা ১২ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ ও পরিচর্যা

গোলাপ ফুলের চারা লাগানোর ২-৩ দিন পরে জমিতে হালকা সেচ দিতে হবে। পরবর্তীতে ১৫-২০ দিন পর পর সেচ দিতে হবে। তবে ক্ষেতে বৃষ্টির অথবা সেচের কারণে অতিরিক্ত পানি জমলে তা বের করে দিতে হবে।

  • এছাড়া ভালো ফলনের জন্য নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
  • পুরনো গাছের কচি ডগা, মরা ডাল পাতা ইত্যাদি ছেটে দিতে হবে; এত গাছের কাঠামো ভালো থাকবে।
  • পুরনো গাছ এক স্থান থেকে উঠিয়ে অন্য স্থানে লাগানো হয়; তাহলে গর্তে লাগানোর পর সেখানে প্রচুর পানি দিতে হবে।

গোলাপ ক্ষেতের মাটি হালকা নিড়ানী দিতে হবে; নিড়ানী দিলে গাছের মূল সহজেই আলো বাতাস,পানি পায় যার ফলে মাটির আর্দ্রতার ধারন ক্ষমতা বাড়ে এবং আগাছা মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।

রোগবালাই দমন

গোলাপ গাছে কালো দাগ রোগ, ডগা শুকানো রোগ, পাউডার মিলডিউ রোগ ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এছাড়া যেসব উল্লেখ যোগ্য পোকা-মাকড় আক্রমণ করতে পারে তা বিস্তারিত তুলে ধরা হল।

উই পোকা:  এই পোকা কাটিং লাগাবার পর নতুন শিকড় বের হবার আগেই পুরান শিকড়গুলোকে নষ্ট করে দেয়।

গোলাপ চাষের জমিতে উইপোকা থাকার সম্ভাবনা থাকলে পাইরিফস বা উপযুক্ত কীটনাশক দিয়ে মাটি শোধন করে নিলে এই পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা যাবে।

লাল ক্ষুদে মাকড়সা: এ পোকা পাতার নিচের পিঠে থেকে পাতার রস চুষে খায় বলে গাছ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। শুধুমাত্র ঠান্ডা পানি জোরে সেপ্র করেও এই পোকা দমন করা যায়।

নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে কেলথেন-৪২, থিওভিট-৮০, ইথিওন-৪৬.৫ ইসি প্রভৃতি কীটনাশক পাতার উল্টো পিঠে স্প্রে করতে হবে।

শ্যাফার বিটল: এ পোকা বড় ও লালচে রং এর। রাতের বেলা হাতে বেছে এই পোকা দমন করা যায়।

পাইরিফস, পাইরিবান বা উপযুক্ত কীটনাশক মাটি শোধন করলে এই পোকার আক্রমণ বাঁচা যায়।

শুঁয়ো পোকা:  এই পোকা গাছের পাতা খেয়ে ক্ষতি করে। পোকা অল্প ও বড় আকারের হলে ধরে মেরে ফেলা সহজ।

থ্রিপস: মার্চ হতে এপ্রিল পর্যন্ত গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ায় থ্রিপসের আক্রমণ হয়। আক্রান্ত ডগা ও  ফুল কেটে পুড়িয়ে ফেলে এবং মিপসিন ৭৫ ডব্লিউপি নামক কীটনাশক সপ্তাহে একবার করে ২/৩ বার পরে দু সপ্তাহ স্প্রে করতে হবে

ডাইব্যাক: রোগাক্রান্ত গাছের ডাল বা কান্ড মাথা থেকে কালো হয়ে মরতে শুরু করে। ডাইব্যাক শুরু হলে রোগাক্রান্ত বেশ নিচ পর্যন্ত কেটে ফেলে দিয়ে কাটা মাথায় প্রুনিং পেইন্ট লাগিয়ে দিতে হবে।

পাউডারী মিলডিউ: শীতের শেষের দিকে পাতায় সাদা সাদা পাওডারের মত দেখা যায়। রোগাক্রান্ত ডগা ও পাতা তুলে পুড়িয়ে দিতে হবে।  এছাড়া হেকোনাজল ৫ ইসি বা ডাইথেন এম-৪৫ অথবা ইন্ডোফিল এম-৪৫ দিয়ে স্প্রে করতে পারেন।

যেভাবে টবে গোলাপ ফুল চাষ করবেন

টবে অধিকাংশ মানুষ গোলাপ ফুল চাষ করতে পছন্দ করে। তাই টবে এই ফুলের চাষ করতে চান, তাহলে এ সম্পর্কে কিছু বিষয় জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

  • টবে নতুন চারা না লাগিয়ে এক বছরের পুরোনো চারা লাগাতে পারেন।
  • চারা সোজাভাবে গর্তে লাগিয়ে চারার শেকড় সম্পূর্ণ মাটি দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দিতে হবে।
  • বড় গোলাপ পেতে এবং নতুন শাখা ভালোভাবে বিস্তৃতের জন্য নিয়মিত গাছের পুরোনো, ক্ষত ও রোগাক্রান্ত ডাল কেটে দিতে হবে। ছাঁটাইকৃত ডালের সামনে ছত্রাকনাশক ঘন করে গুলে লাগিয়ে দিন।
  •  আশ্বিন মাসকে গাছ ছাঁটাইয়ের উত্তম সময়।
  • গাছ ছাঁটাইয়ের ১০-১২ দিন আগে সার প্রয়োগ করতে হবে (গাছ প্রতি ২-৩ কেজি গোবর, ৫০ গ্রাম টিএসপি ও ৫০ গ্রাম পটাশ)।
  • টবের উপর থেকে মাটি সরিয়ে নিচের মাটি কিছুটা আলগা করে সারগুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • এসময় লক্ষ্য রাখতে হবে, শিকড় যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হয়।
  • হাঁস-মুরগি বা কবুতরের বিষ্ঠা সার হিসেবে গোলাপ গাছে দেওয়া যেতে পারে।
  • চারা রোপনের পরে প্রথমদিকে ঘন ঘন পানি দিতে হবে।
  •  তারপর খরা মৌসুমে প্রতি ৭-৮ দিন পর পর পানি দিতে হবে।
  • টবের জন্য সার ও মাটি এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে মাটি বেশ ফাঁপা থাকে, তবে পানি যেন না জমে।
  • ১ ভাগ দো-আঁশ মাটি, ৩ ভাগ গোবর সার বা কম্পোষ্ট, ১ ভাগ পাতা পচা সার, আধ ভাগ বালি (নদীর সাদা বালি হলে ভালো) দিয়ে মিশ্রণ তৈরি করে তাতে এক মুঠো সরিষার খৈল ও এক চামচ চুন মিশিয়ে ১টি ৮ ইঞ্চি টবে একমাস রেখে দিতে হবে।
  • এই একমাস টবে পানি দিয়ে মাটি উল্টে পাল্টে দিতে হয়; এতে মাটির মিশ্রণ ভালো হবে।
  • মাটির মিশ্রণে ব্যবহৃত চা পাতা ব্যবহার করেও ভালো ফল পাওয়া যায়।
  • টবে নিচের কয়েক সেমি পরিমাণ অংশে ইট বা মাটির হাড়ি পাতিলের ভাংগা টুকরা এমনভাবে বিছিয়ে দিতে হয় যাতে টবের মাটি এগুলোর উপর থাকে। এতে বাড়তি পানি নিষ্কাশনে সুবিধা হবে।
ফলন ও ফুল সংগ্রহ

জমিতে গোলাফ চারা রোপণের ৮০ থেকে ১১০ দিনের মধ্যেই গাছে কুড়ি আসা শুরু করে। এই পর্যায়ে ফুলের পাপড়ি মেলে না। তাই এই অবস্থায় ফুল সংগ্রহ করা উচিত।

গোলাপের  জাত ভেদে ফলন ভিন্ন হয়; সাধারনত প্রতি বছর গাছ প্রতি ৩০-৩৫ টি ফুল উৎপন্ন হয়ে থাকে।

–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।  বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?