দেশে প্রায় সব অঞ্চলে গাজর চাষ হয়। রঙিন এই সবজির চাষাবাদ সারা বছর হলেও শীতের সময় এর ফলন বেশি হয়।
তরকারি, সালাদ এবং হালুয়ায় গাজরের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে সহজে নষ্ট না হওয়া গাজরের চাহিদা প্রচুর। এছাড় সারা বছর চাহিদা থাকায় গাজর চাষ তুলনামূলক লাভজনক।
তাই আজ আমারা এই নিবন্ধে আধুনিক গাজর চাষা পদ্ধতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আদ্যোপান্ত আলোচনা করব।
যে পদ্ধতিতে গাজর চাষ করে লাভবান হবেন
বাংলাদেশে গাজরের কোন অনুমোদিত জাত নেই। সাধারণত আমদানি করা বীজে দুই মৌসুমে গাজর চাষ করা হয়। এর মধ্যে একটি হল গ্রীষ্মকালীন এবং অপরটি হল নাতিশীতোষ্ণ।
চাষ পদ্ধতি…
- সুনিষ্কাশিত বেলে দোঁআশ ও দোআঁশ মাটি গাজর চাষের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট।
- গাজরের চাষাবাদের জমিতে যেন পর্যাপ্ত আলো-বাতাসযুক্ত থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে জমির মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হবে।
- আশ্বিন থেকে কার্তিক (মধ্য সেপ্টেম্বর-মধ্য নভেম্বর) মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
- প্রতি হেক্টরে ৩ থেকে ৪ কেজি বীজ লাগে।
- সারি হতে সারির দূরত্ব হবে ২০ -২৫ সেন্টিমিটার। গাছ-গাছের দূরত্ব ১০ সেন্টিমিটার।
- গাজরের বীজ সারিতে বপন করা ভালো। এতে গাজরের যত্ন নেওয়া সহজ হয়।
- গাজরের বীজ খুব ছোট বিধায় শুকনা ছাই বা গুঁড়া মাটির সঙ্গে মিশিয়ে বোনা ভালো।
- বীজ বোনার পর ক্ষেতে হালকা করে পানি দিতে হবে।
বীজ থেকে চারা গজাতে ১৫-২০ দিন সময় লাগতে পারে। তবে বপনের আগে বীজ ভিজিয়ে রাখলে (১৮ থেকে ২৪ ঘণ্টা) ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে চারা বের হয়।
সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা
গাজরের ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে যত সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করা উত্তম। এছাড়া গাজর চাষে হেক্টরপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হবে। সারের পরিমাণ হেক্টর প্রতি……
- গোবর অথবা জৈবসার ১০ টন।
- ইউরিয়া ১৫০ কেজি।
- টিএসপি ১২৫ কেজি।
- এবং এসওপি অথবা এমপি ২০০ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
জমি তৈরির সময় সম্পূর্ণ গোবর ও টিএসপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া ও এমপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া সমান দুই কিস্তিতে চারা গজানোর ১০ থেকে ১২ দিন ও ৩৫ থেকে ৪০ দিন পর মাটির উপরে প্রয়োগ করতে হবে।
বাকি অর্ধেক এমপি সার চারা গজানোর ৩৫-৪০ দিন পর মটির উপরে প্রয়োগ করতে হবে।
এছাড়া……
- চারা গজানোর ৮ -১০ দিন পর ১০ সেন্টিমিটার পরপর ১টি করে গাছ রেখে বাকি সব উঠিয়ে ফেলতে হবে।
- একই সঙ্গে আগাছা পরিষ্কার ও মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে।
- প্রয়োজনমতো সেচ দেওয়া ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- মাটির জো দেখে দুই সপ্তাহ পরপর ৩- ৪ বার সেচ দেওয়া গাজর উৎপাদনের জন্য ভালো।
রোগ বালাই ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা
গাজর ক্ষেতে জাব পোকা আক্রমণ করে, গাছের কচি অংশের রস শুষে খেয়ে গাছের ব্যাপক ক্ষতি করে।
পোকা দমনের জন্য রগোর এল -৪০, ক্লাসিক ২০ ইসি, টিডফেট ৭৫ এসপি, টিডো ২০ এসএল ইত্যাদি কীটনাশকের যে কোনো একটি অনুমোদিত মাত্রায় ব্যবহার করা যেতে পারে। অথবা বাইকাও-১ প্রয়োগ করতে হবে।
এছাড়া গাজরের হলুদ ভাইরাস রোগও দেখা দেয়। লীফ হপার পোকার মাধ্যমে গাজরে অনেক সময় হলুদ ভাইরাস রোগ দেখা যায়।
এ পোকার আক্রমণের ফলে গাজরের ছোট বা কচি পাতাগুলো হলুদ হয়ে যায়, পরে কুঁকড়িয়ে যায় এবং লক্ষণীয়ভাবে গাছের পাতার পাশের ডগাগুলো হলুদ ও বিবর্ণ হয়ে যায়।
গাজরে লীফ হপার পোকার আক্রমণ হলে দ্রুত দমনের ব্যবস্থা নিতে হবে। আক্রান্ত ডালপালা কেটে ফেলতে হবে এবং চারপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
সবিক্রন ৪২৫ ইসি ২ মিলিলিটার পানি অথবা রেলোথ্রিন ১ মিলিলিটার পানিতে স্প্রে করতে হবে।
টবে বা ছাদ বাগানে গাজর চাষের সহজ পদ্ধতি
বর্তমানে অনেকেই টবে বা ছাদ বাগানে গাজরসহ বিভিন্ন সবজির চাষ করছে। এতে সহজেই পরিবারের সবজির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে।
টবে গাজর চাষ করার পদ্ধতি
- টব বাছাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বড় আকারের টব হলে ভালো; এতে একসাথে অনেক বীজ বোনা যাবে।
- টবের গভীরতা হতে হবে কমপক্ষে ১২ ইঞ্চি। এছাড়া পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- সব ধরনের মাটিতেই গাজর চাষ করা গেলও বেলে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী।
- আজকাল অবশ্য কোকোপিট ও জৈব সারের মিশ্রণও পাওয়া যায়।
- ওই মাটিও গাজরের চাষের জন্য ভালো। তবে যে মাটিই হোক তা আগে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
- টবের মাটি তৈরি হয়ে গেলে তাতে বীজ বোনতে হবে।
- যেহেতু গাজরের বীজ যেহেতু ছোট অনেকগুলো একসাথে বোনতে হয়।
- অবশ্যই চারা বেড়ে ওঠার পর সুস্থ চারা রেখে বাকিগুলো ফেলে দেওয়া যায়।
- আকারে ছোট হওয়ায় গাজরের বীজের সাথে ছাই বা মাটির গুড়া মিশিয়ে বোনতে হয়।
- বীজ বোনার আগে তা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- সকালে পানিতে ভিজালে বিকালের দিকে বোনা ভালো।
- গাজর চাষে যত বেশি পরিমাণ জৈব সার দেওয়া যায় ততই ভালো।
- গোবর সার, কম্পোস্ট সার, কেঁচো সার, তরকারির খোসা এসব দিলে ফলন ভালো হয়।
- এ ছাড়া অজৈব সার হিসেবে টিএসপি ও এমওপি ও ব্যবহার করা যাবে।
- প্রয়োজনে সামান্য ইউরিয়া দেয়া যেতে পারে।
- তবে নাইট্রোজেন জাতীয় সার বেশি ব্যবহার করা যাবে না।
- এ ছাড়া প্রতি দুই সপ্তাহ পর পর এক বার করে চা পাতা শুকিয়ে টবের গোড়া ব্যবহার করা যায়। এটিও গাছের জন্য খুব উপকারী।
গাজর চাষে নিয়মিত পানি দিতে হয়। প্রতিদিন অন্তত কয়েক ঘণ্টা রোদ পায় এমন জায়গায় রাখতে হবে। এ ছাড়া বীজ থেকে যখন চারা গজালে অবশ্যই চারার ঘনত্ব কমাতে হবে ও নিড়ানি দিতে হবে। আগাছা থাকলে তুলে ফেলতে হবে।
গাজর সংগ্রহঃ
বীজ বপন করার তিন মাসের মধ্যেই সবজি হিসেবে গাজর খাওয়ার জন্য ক্ষেত থেকে সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। হেক্টরপ্রতি গাজরের ফলন ২০ থেকে ২৫ টন। সব ধরনের নিয়ম মেনে গাজর চাষ করলে বেশ লাভবান হওয়া যায়।
–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
আরো পড়ুন …
- সহজ ও সঠিক মুলা চাষ পদ্ধতি ( ১২ মাসই চাষ করুন )
- সঠিক পদ্ধতিতে ফুলকপি চাষ, আগাম চাষে দ্বিগুণ লাভ!
- যেভাবে বাঁধাকপি চাষ করবেন, শিখে নিন সঠিক পদ্ধতি
- যেভাবে উন্নত পদ্ধতিতে মরিচ চাষ করবেন
- আধুনিক শিম চাষ পদ্ধতি
- আধুনিক বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।