ইদানিং আমাদের দেশে ভুট্টা চাষ বাড়ছে। অধিক উচ্চফলনশীল ও বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য দানা শস্য ভুট্টা বর্ষজীবী গুল্ম প্রকৃতির ফসল।
ভুট্টা দানা মানব খাদ্য এবং সবুজ পাতা উন্নত মানের গােখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে; এছাড়া গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি ও মাছের খাদ্য হিসেবে ভুট্টার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
ব্যাপক চাহিদার পাশাপাশি আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় ভুট্টার চাষাবাদে; চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। তাই আজ আমরা এই নিবন্ধে ভুট্টা চাষের পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ভুট্টা চাষ করবেন যেভাবে
প্রায় বছর জুড়ে (খারিফ, রবি, গ্রীষ্মকালীন) ফসল হিসাবে ভুট্টা চাষ করা যায়। তবে, ভালো ফলন পেতে নির্ধারিত সময়ে মধ্যে যতটা সম্ভব আগাম বীজ বপন করা উত্তম।
আমাদের দেশে রবি মৌসুম (অক্টোবর থেকে নভেম্বর) এবং খরিপ মৌসুম (মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ) পর্যন্ত ভুট্টার বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
সুনিষ্কাশিত আলো-বাতাস পায় এমন ছায়ামুক্ত হালকা বেলে, দোঁয়াশ এবং কাদা দোঁয়াশ মাটির জমিতে ভুট্টা চাষাবাদ ভাল হয়। সামান্য আম্লিক মাটিতে ভুট্টা চাষ ভাল হয়।
তবে মাটিতে যথাযথ জৈব পদার্থ ও খাদ্যোপাদান থাকতে হবে; কারন ভুট্টা প্রচুর পরিমানে মাটির খাবার টেনে নেয়।
ভুট্টার বীজ বপন পদ্ধতি
সাধারণত ভুট্টা বীজ সারিতে বপন করা হয়; তবে ছিটিয়েও বপন যায়। সারিতে বুনলে বিঘা প্রতি ৩ কেজি আর ছিটিয়ে বুনলে বিঘা প্রতি ৪ থেকে ৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হবে।
- সারিতে বুনলে লাইন থেকে লাইনের দুরত্ব হবে ৭০ সেন্টিমিটার (২৮ ইঞ্চি), বীজ থেকে বীজের দুরত্ব হতে হবে ২৫ সেন্টিমিটার (১০ ইঞ্চি), বীজ বপনের গভীরতা হবে ৩-৪ সেন্টিমিটার (১-১.৫ ইঞ্চি) পর্যন্ত।
- ছিটিয়ে বপনের সময় এমন ভাবে বীজ ছিটিয়ে দিতে হবে; একক এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমান গাছ যাতে থাকে।
- তবে এই কথা মাথায় রাখতে হবে গাছের পরিমান বেশি হলে ভুট্টা ছোট হয় ও পুষ্ট বীজের অভাব থাকে; ফলন কম পাওয়া যাবে।
- সারিতে বুনলে বীজ থেকে চারা বেরোনোর পর সবল চারা গুলো রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে।
- ছিটিয়ে বীজ বুনলে চারা বেরোনোর ১০ দিন পর জমিতে নিড়ান দিয়ে গাছের সংখ্যা বিঘা প্রতি ৮০০০- ৮৫০০ এর মধ্যে রাখতে হবে।
- জাত নির্বাচন ভুট্টার দুই ধরনের জাতের চাষাবাদ করা হয় কম্পোজিট ও হাইব্রিড।
- কম্পোজিট জাতের শংসিত বীজ কিনে বপন করলে ৩-৪ বছর পর পর চাষ করা যায়।
- কিন্তু হাইব্রিড জাতের ক্ষেত্রে প্রতি বছর বাজার থেকে নতুন বীজ কিনে লাগাতে হয়।
বপনের আগে বীজ শোধনে প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে ২.০ গ্রাম কার্বেডাজিম বা ম্যানকোজেব জাতীয় ওষুধ মাখিয়ে ভাল করে শোধন করে নেওয়া উত্তম।
জমি তৈরি ও সার প্রয়ােগ
ভুট্টার চাষাবাদের জমি ৪ থেকে ৫ বার গভীর চাষ ও ও মই দিয়ে তৈরি করতে হবে। শেষ চাষের আগে মােট ইউরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ এবং অন্যান্য সারের সবটুকু ছিটিয়ে ভালোভাবে চাষ দিয়ে সর গুলো মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
ভুট্টা চাষে বিভিন্ন প্রকার সারের পরিমাণ (বিঘা প্রতি) নিচে দেওয়া হলাে…
- বিঘা প্রতি জিংক সালফেট ২০-২৫ কেজি।
- ৬-৭ কুইন্টাল গোবর সার প্রয়ােগ করলে ভালাে ফলন পাওয়া যায় ( বর্ষায় শেষ চাষের ১০ থেকে ১৫ দিন আগে জমিতে দিলে ভাল)।
- ইউরিয়া ৪০ থেকে ৪৫ কেজি।
- পটাশ ১৫ থেকে ২০ কেজি।
- ৫৫ থেকে ৬০ কেজি সি. সু. ফ.।
ইউরিয়া সার ৫ ভাগে প্রয়োগ করলে বেশি ফলন পাওয়ার পাশাপাশি সারের ব্যবহার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। ইউরিয়া কে নিন্মলিখিত ভাবে ভাগ করা যায়…
- মুল সার শেষ চাষের সময়- ১০-১২ কেজি।
- চার থেকে ছয় পাতা দশায় – ১০ কেজি।
- আট পাতা দশায়- ১০-১২ কেজি।
- পুরুষ ফুল আসার সময়- ৮ কেজি (গাছের মাথায় ঝালর ফুল)।
- বীজ পরিপুষ্ট হবার সময়- ২-৩ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
তবে, সার প্রয়োগ সর্বদা মাটি পরীক্ষা করার পর সুপারিশ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করা উচিত। পর্যাপ্ত পরিমানে জৈব সার প্রয়োগে গাছ ও ফলন দুইই ভাল হয়।
সেচ ও পরিচর্যা
- আশানুরূপ ফলন পেতে হলে রবি মৌসুমে ভুট্টা ক্ষেতে ৩ থেকে ৪ বার সেচ দিতে হয়।
- পাঁচ পাতা পর্যায়ে প্রথম বার, দশ পাতা পর্যায়ে দ্বিতীয় বার, মােচা বের হওয়ার সময়ে তৃতীয় এবং দানা বাঁধার পূর্বে চতুর্থ বার সেচ দিতে হবে।
- তবে ক্ষেতে যাতে পানি যেন জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- খারিফ বা বর্ষা মৌসুমে ভুট্টা ক্ষেতে আলাদা করে সেচ দিতে হয় না; বিশেষ ক্ষেত্রে পানি নিকাশির ব্যবস্থা রাখতে হবে। কারণ জ্বলাবদ্ধতা ভুট্টার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
- চারা গজানাের ৩০ দিনের মধ্যে জমি থেকে অতিরিক্ত চারা তুলে ফেলতে হবে।
- চারার বয়স এক মাস না হওয়া পর্যন্ত জমি আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
- দ্বিতীয় কিস্তির ইউরিয়া সার উপরি প্রয়ােগের সময় দুই সারির মাঝখান থেকে মাটি গাছের গােড়া বরাবর তুলে দিতে হবে।
- অন্তর্বর্তী পরিচর্যা খারিফ চাষে ভুট্টার খেতে আগাছার উপদ্রব বেশি হয়।
- এক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর্যন্ত জমির আগাছা নিয়ন্ত্রন করতে পারলে গাছের বৃদ্ধি আশানুরূপ হয় ও ফলন বৃদ্ধি পায়।
- বর্ষায় চাষের সময় আগাছা ভুট্টা চাষে সমস্যা সৃষ্টি করে।
- তাই বর্ষাকালীন চাষে আগাছার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ % ভুট্টার ফলন কমে যেতে পারে।
পােকা দমন ব্যবস্থাপনা
ভুট্টা ক্ষেতে পােকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হলেও কয়েকটি রােগ দেখা দিতে পারে। যেমন-ভুট্টার বীজ পচা ও চারা মরা রােগ, পাতা ঝলসানাে রােগ, কাণ্ড পচা রােগ, মােচা ও দানা পচা রােগ ইত্যাদি।
- এ রােগগুলাে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের বীজ ও মাটিবাহিত ছত্রাকের আক্রমণে হয়ে থাকে।
- বীজ বপনের সময় মাটিতে রস বেশি এবং তাপমাত্রা কম থাকলে বীজ পচা ও চারা মরা রােগ দেখা দেয়।
- পাতা ঝলসানাে রােগে আক্রান্ত গাছের নিচের দিকের পাতায় লম্বাটে ধূসর বর্ণের দাগ দেখা যায়। পরে তা গাছের উপরের অংশে ছড়িয়ে পড়ে। রােগের আক্রমণ বেশি হলে পাতা আগাম শুকিয়ে যায় এবং গাছ মরে যায়।
এ রােগ গুলো দমনে রােগ প্রতিরােধী জাত ব্যবহার করতে হবে। বীজ বপনের পূর্বে শােধন করে নিতে হবে। ফসল তোলার কাটার পর পরিত্যক্ত অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। এছাড়া একই জমিতে বার বার চাষ বন্ধ করতে হবে।
মাটি শোধনের জন্য প্রতি বিঘায়(৩৩ শতাংশে) ৮-১০ কেজি বায়োডার্মা সলিড শেষ চাষের সময় মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। এতে মাটির ক্ষতিকর জীবাণু দমন হবে ও জৈব সারের কাজ করবে।
এছাড়া চারা অবস্থায় কাটুই পােকার লার্ভা ভুট্টা গাছের গােড়া কেটে দেয়। এরা দিনের বেলায় মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে এবং রাতে বের হয়।
সদ্য কেটে ফেলা গাছের চারপাশের মাটি খুড়ে পােকার লার্ভা বের করে মেরে ফেলতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে ফুরাডান অথবা ডারসবার্ন অনুমােদিত মাত্রায় ব্যবহার করে জমিতে সেচ দিতে হবে।
পার্পল রঙিন ভুট্টা চাষ
- পার্পল বা রঙিন জাতের ভুট্টা উচ্চ পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং খেতে রাজশাহীর বিখ্যাত পাকা ফজলি আমের সমতুল্য।
- রঙিন ভুট্টার মিষ্টতা (BRIX)-২০ অপরদিকে পাকা ফজলি আমের মিষ্টতা-১৯।
- হাজার বছর ধরে পেরুর নৃগোষ্ঠিরা এই রঙিন ভুট্টা মুখরোচক খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করতো।
- এছাড়া রঙিন ভুট্টা প্রাচীনকাল থেকে Incan (ইনকান) সভ্যতার নৃগোষ্ঠিরা রঙিন ভুট্টার রস বেভারেজ (পানীয়) হিসেবে ব্যবহার আসছে।
- রঙিন ভুট্টা ব্লু-বেরির (Bluberres) চেয়েও এই রঙিন ভুট্টা ৫-১০ গুন বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (Antioxidants) সমৃদ্ধ যা ডালিমের দানার মত কাঁচাও খাওয়া যায়।
- রঙিন ভুট্টা বীজ সংগ্রহ করে চারা করার জন্য একটি টবে একটি করে বীজ বোনতে হবে।
- টবের গভীরতা হবে দেড় ইঞ্চি এবং চওড়ায় এক ইঞ্চি।
- এরপর ১২ দিন বয়সী ভুট্টার চারা ‘রেইজড বেড ফারো অ্যান্ড টুইন প্লাটেশন’ পদ্ধতিতে জমিতে বপন করতে হবে।
- বপনের পর প্রতিটি চারা থেকে ৩ থেকে ৪টি কার্যকরী কুঁশি বের হয়।
- প্রতিটি কুঁশি থেকে ১ থেকে ২টি কার্যকরী ভুট্টার মোচা বের হয়।
- আর প্রতিটি ভুট্টা গাছেই ৩ থেকে ৪টি ভুট্টার মোচা হয়।
- সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে এ ভুট্টা চাষে ব্যবহার করা যেতে পারে বায়োগ্যাস, কেঁচো সার, হাড়ের গুঁড়া, শিংয়ের গুঁড়া, কোকো কয়ার ও সামান্য পরিমাণে ডিএপি, এমওপি এবং ইউরিয়া সার।
- কীটনাশক হিসেবে মেহগনি ও নিমতেল ব্যবহার করা যায়।
- ফলে রঙিন ভুট্টা চাষের অর্গানিক প্লটে মোটেও আর্মি ওয়ার্ম পোকার কোনো আক্রমণ দেখা যায় না।
ফলন ও ফসল সংগ্রহ
ভুট্টা গাছের মােচা ৭৫ থেকে ৮০% পরিপক্ব হলে ফসল সংগ্রহ করা যাবে। ক্ষেতে ভুট্টার মােচা চকচকে খড়ের রং এবং পাতা কিছুটা হলদে হলে, দানার জন্য ভুট্টা সংগ্রহের উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়।
মােচা সংগ্রহের পর ৪ থেকে ৫ দিন রােদে শুকাতে হবে।
রবি মৌসুমে গাছের জীবনকাল ১৩৫ থেকে ১৫৫ দিন এবং খরিপ মৌসুমে জীবনকাল ৯০ থেকে ১১০ দিন। রবি মৌসুমে ফলন বেশি হয় এবং খরিপ মৌসুমে ফলন কম হয়।
–বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
আরো পড়ুন …
- বিলাতি ধনিয়া পাতা চাষ পদ্ধতি জেনে নিন
- কারিপাতা চাষ পদ্ধতি জেনে নিন
- পোলাও পাতা চাষ পদ্ধতি
- যেভাবে পুদিনা পাতা চাষ করবেন
- সম্পূর্ণ আধুনিক লেটুস পাতা চাষ পদ্ধতি
- সূর্যমুখী ফুল চাষ, জেনে নিন সঠিক ও সহজ পদ্ধতি
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।