ধুন্দল চাষ ও রোগ-বালাই দমন পদ্ধতি জেনে নিন

ছাদে টবে বা ড্রামে খুব সহজেই মজাদার সবজি ধুন্দল চাষ করা যায়। এ সবজি হাল্কা সবুজ, আঁশবিহীন, খেতে মোলায়েম ও অত্যন্ত সুস্বাদু।

বর্তমানে দেশে বাড়ির ছাদে কিংবা ব্যালকুনিতে টব, ড্রাম বা পুরাতন বালতিতে ধুন্দল চাষ করে অনেকই।

কোন ভাবে একটি ধুন্দল চারা বড় করতে পারলে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করা যায় মজাদার এই সবজি।

এবার জেনে নিব ধুন্দল চাষে পদ্ধতি ও রোগ-বালাই দমনে আমাদের কি কি করতে হবে।

ধুন্দল চাষ পদ্ধতি

পোকা-মাকড়, রোগ ও বৃষ্টির পানি সহনশীল ধুন্দুল বর্ষা মৌসুমে চাষ করতে হয়। চারা লাগানোর ৪০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ শুরু করা যায়।

মাটি প্রস্তুত ও জমি নির্বাচন করুন

ধুন্দুল চাষাবাদের জন্য উত্তম উর্বর এটেল দো-আঁশ মাটি।

তবে চাষে জমির প্রথম শর্ত হচ্ছে উঁচু, পানি জমে থাকে না, গাছের কোনো ছায়া থাকে না এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।

সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধা থাকা বাঞ্ছনীয়।

দোঁয়াশ, বেলে দোঁয়াশ মাটি পাওয়া না গেলে এটেল মাটির সাথে দ্বি-গুন হারে গোবর বা কম্পোস সার ও লাল বালি মিশিয়ে ধুন্দল চাষ করা যায় ।

এছাড়া নদীর বালি মাটির সাথে ইটের খোয়া ও শুকনো গোবর মাশিয়েও ধুন্দল চাষ করা যায়।

টব,ড্রাম না থাকলে সিমেন্টের বস্তাতে মাটি ভরেও ধুন্দল চাষ করা যায় ।

বীজ বপনের সময় ও পরিমান

ফাল্গুন-চৈত্র মাস ধুন্দল বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তবে পৌষ ও মাঘ মাস ছাড়া সারা বছরই ধুন্দলের চাষবাদ করা যায়।

ভাল ফলনের জন্য ভালো জাতের বীজ নির্বাচন করতে হবে।

প্রতি শতাংশে ৪ গ্রাম এবং একরপ্রতি ৪০০ গ্রাম বীজ লাগতে পারবেন।

জমি তৈরি ও যেভাবে বীজ বপন করবেন

  • ভালভাবে জমির মাটি চাষ ও মই দিয়ে আগাছামুক্ত ঝুরঝুরা করে নিতে হবে।

    কবির ১ ধুন্দল
    কবির ১ ধুন্দল বীজ কিনুন
  • জমিতে সার প্রয়োগ করার পর ১ ফুট গভীর ও ১.৫ ফুট চওড়া করে মাদা করতে হবে।
  • এক মাদা থেকে অপর মাদার দূরত্ব ২ মিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১ মিটার।
  • তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, জমির চেয়ে মাদা যেন কমপক্ষে ৫-৬ ইঞ্চি উঁচু হয়।
  • ১৫৫ সেমি. প্রশ্বস্ত বেডের উভয় পাশে ৩০ সেমি. (১ ফুট) জায়গা রেখে একটি সারিতে ১ মিটার (৪০ ইঞ্চি) দূরে দূরে বীজ বপন করতে হবে।
  • বীজ বপনের ২৪ ঘণ্টা আগে ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুরোদগম ভাল হয়। প্রতি মাদায় ৪-৫ টি বীজ পুঁতে দিতে হবে।
  • সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধার্থে দুই বেডের মাঝে ৪৫ সেমি. (১৮ ইঞ্চি) চওড়া ও ১৫ সেমি. (৬ ইঞ্চি) গভীর নালা রাখা আবশ্যক।

সার প্রয়োগ

জমিতে সরাসরি সার প্রয়োগ না করে প্রতিটিও মাদায়ও প্রয়োগ করতে পারেন।

সে ক্ষেত্রে প্রতিটি মাদায় পচা গোবর, ছাই, পচা কচুরিপানা, জৈব সার ইত্যাদি মিলিয়ে ৫-৬ কেজি, ১০০ গ্রাম টিএসপি, ৬০-৭০ গ্রাম এমপি মাটিতে ভালোমতো মিশিয়ে দিতে হবে।  এবং ৫-৬ দিন অপেক্ষা করে বীজ বপন করতে হবে।

এছাড় ১৫-২০ দিন পর পর প্রতি মাদায় ৫০ গ্রাম হারে ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

সেচ

মাটিতে রস কম থাকলেই সেচ দেয়া প্রয়োজন। তবে ইউরিয়া সব প্রয়োগের পর সেচ দেয়া উত্তম।

জেনে নিন রোগ-বালাই দমন পদ্ধতি

ধুন্দুল ক্ষেত সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। রোগাক্রান্ত ও মরা পাতা পুঁতে ফেলতে হবে। ফল ছিদ্রকারী পোকা ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। এ রোগের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

পাতা কোকড়ানো রোগ

ধুন্দলের পাতা কোকড়ানো রোগের বাহক পোকা। ধুন্দল গাছ বাহক পোকার মাধ্যমে পাতা কোকড়ানো আক্রান্ত হয়।

তাই বাহক পোকা দমন-ই ভাইরাস ঠেকানোর একমাত্র উপায়।

সাদামাছি পাতা কোড়ানো রোগের বাহক পোকা দমনে টোপাম্যাক অত্যন্ত কার্যকর।

প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ শতক জমির জন্য ২ গ্রাম, একর প্রতি মাত্রা ৪০ গ্রাম, হেক্টর প্রতি মাত্রা ১০০ গ্রাম।

প্রবাহমান গুণসম্পন্ন হওয়ায় দ্রুত গাছের ভিতরে প্রবেশ করে ফলে আক্রান্ত ফসলের ভিতরে থাকা পোকা মারা যায়।

টোপাম্যাক স্প্রে করার ১৪ দিনের মধ্যে ফসল খাওয়া যাবেনা। সকল ধরণের বালাইনাশক বিকেলে ব্যবহার করা উত্তম।

চারাগাছে কাটুই পোকার আক্রমণ

কাটুই পোকার আক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহার করুন- “সাইকন ৫৫ ইসি” (স্পর্শক, পাকস্থলীক্রিয়া ও শ্বাসরোধ ক্রিয়াসম্পন্ন কীটনাশক)।

কাটুই পোকা দমনে ৫ শতক জমির জন্য ১০ লিটার পানিতে ২০ মিলি, প্রতি একরে ৪০০ মিলি এবং প্রতি হেক্টরে ১ লিটার।

পাকস্থলীক্রিয়া গুণসম্পন্ন হওয়ায় গাছের ভিতরে থাকা পোকা রস শোষণের ফলে মারা যায়।

স্পর্শক গুণসম্পন্ন হওয়ায় ইহা পোকার গায়ে লাগা মাত্রই পোকা মারা যায়।

শ্বাসরোধ ক্রিয়া গুণসম্পন্ন হওয়ায় ইহা মাটিতে বসবাসকারী ক্ষতিকারক পোকার শ্বাসরোধ করে পোকাকে মেরে ফেলে।

ধুন্দলের ফল ছিদ্রকারী পোকা

ধুন্দলের ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনে ব্যবহার করুন লরেন্ট (স্থানীয়ভাবে অনুপ্রবেশযোগ্য স্পর্শক ও পাকস্থলীক্রিয়া গুণসম্পন্ন প্রবাহমান কীটনাশক)।

প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ শতক জমির জন্য ১০ গ্রাম, একর প্রতি মাত্রা ২০০ গ্রাম, হেক্টর প্রতি মাত্রা ৫০০ গ্রাম।

লরেন্ট প্রবাহমান গুণসম্পন্ন হওয়ায় দ্রুত গাছের ভিতরে প্রবেশ করে ফলে আক্রান্ত ফসলের ভিতরে থাকা পোকা মারা যায়।

স্পর্শক গুণসম্পন্ন হওয়ায় ইহা পোকার গায়ে লাগা মাত্রই পোকা মারা যায়।

চারা গাছের ঢলে পড়া / গোড়া পচা রোগ

চারা গাছের ঢলে পড়া / গোড়া পচা রোগ দমনে ব্যবহার করুন প্রোকার্ব (প্রতিরোধক, প্রতিষেধক ও প্রবাহমান ছত্রাকনাশক)।

মাটির উপরের অংশ এবং গোড়া সহ সম্পূর্ণ গাছ ভিজিয়ে স্প্রে করতে হবে। ১০ লিটার পানিতে ৫ শতক জমির জন্য ১০ মিলি, একর প্রতি ২০০ মিলি, হেক্টর প্রতি মাত্রা ৫০০ মিলি।

আবহাওয়া ও রোগের তীব্রতার উপর ভিত্তি করে ৭-১৪ দিন পরপর গাছ ভিজিয়ে বাতাসের অনুকূলে প্রোকার্ব স্প্রে করুন।

চারাগাছের যেকোনো রোগের অপ্রতিদ্বন্দী ভাবে কাজ করে।  প্রোকার্ব স্প্রে করার ৭-১০ দিন পর ফসল সংগ্রহ করা যায়।

চারা গাছের ঢলে পড়া রোগের সমাধান

অধিক ফলন পেতে স্প্রে করুন “ফসলি গোল্ড”। ২০ মিলি ফসলি গোল্ড ১০ লি: পানিতে মিশিয়ে প্রতি ২০-২৫ দিন পর পর স্প্রে করলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়।

মাচা তৈরি :
  • মনে রাখতে হবে ধুন্দল একটি লতা জাতীয় উদ্ভিদ তাই । গাছের বৃদ্ধির জন্য ।
  • বাঁশ, কঞ্চি দিয়ে ভাল করে মাচা তৈরি করে তাতে নারেকেল গাছের ডাল বিছিয়ে দিলে গাছটি সহজেই বেয়ে উঠতে পারবে।
  • গাছের লতাগুলো দু’ তিন হাত বড় হলে প্রত্যেকটি লতার আগা পিন্চিং করে দিন ।

এতে নতুন নতুন ডগা বা শাখা প্রশাখা বৃদ্ধি পাবে ।

মনে রাখবেন , ধুন্দুলের প্রথমে বেরে উঠা শাখাটি থেকে কোন ফলন হয় না । নতুন নতুন শাখা প্রশাখা থেকেই ফলন হয় । এই শাখাগুলোকে পিন্চিং বা ভেঙ্গে দেওয়াকেই ওয়ান জি, টু জি, থ্রি জি বলে । জি – মানে জেনারেশন ।

অধিক ফলন পাবার উপায় :

প্রখর রোদের উত্তাপ থেকে গাছকে রক্ষা করার জন্য গাছের গোড়া মালচিং বা ঢেকে দিতে হবে ।

মালচিং হচ্ছে, খের কুড়া অথবা কচুরি পানা দিয়ে গাছের গোড়াকে ঢেকে দেওয়া ।

ফলে প্রখোর সূর্যের তাপ থেকে গাছ রক্ষা পায় । গাছের গোড়ার মাটির আদ্রতা ঠিক থাকে ।

খেয়াল রাখতে হবে , টব বা ড্রামের মাটি যেন কিছুতেই শুকিয়ে না যায় ।

গাছে ফুল চলে এলে, গাছের গোড়া থেকে কয়েক ইন্চি দূরে পাটাশ ও টিএসপি সার প্রয়োগ করলে ভাল ফুল ও ফলের পরিমান বৃদ্ধি পাবে।

এছাড় গাছে ফুল চলে এলে ফ্লোরা নামের PGR (Plant Growth Regulator) স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে ।

এসময় ছাই ছাড়া অন্য কোন প্রকার কীটনাশক ব্যবহার করলে ফসল বিষাক্ত হয়ে যাবে । এবং ফলন কম হবে ।

ফসল সংগ্রহ ও ফলন

বীজ বপনের পর ৪০-৪৫ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ শুরু করা যায়। ফল বাতি হলে বোঁটা কেটে সংগ্রহ করতে হবে।

প্রতি শতকে ফলন ১২০-১৪০ কেজি এবং একরপ্রতি ফলন ১২-১৪ টন।

শেষ কথা

ধুন্দলের ভাল ফলনের জন্য জমি আগাছা মুক্ত রাখার পাশাপাশি প্রয়োজনে সেচ ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

এছাড়া গাছ লতানোর জন্য মাচার ও রোগবালাই দমনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?