কৃষি কথা

সঠিক ও সহজ করলা বা তিত করলা চাষ পদ্ধতি

তিত করলা চাষ পদ্ধতি

আমাদের দেশে বহুল পরিচিত সবজি করলা বা তিত করলা চাষ প্রায় সারা বছরই করা যাচ্ছে।

করলা তেঁতো হলেও এই সবজির ফলনে হাসি ফুটেছে কৃষকদের মুখে। ইদানিং আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণের ফলে করলা চাষে মাত্র দেড় মাসে ফলন পাওয়া যায়।

এদিকে অল্প সময়ে কম পুঁজিতে অধিক ফলন ও বেশি লাভ হয় বলে করলা চাষে আগ্রহী হচ্ছে কৃষকরা।

তাই চাষিদের মাঝে এই ফসলের  জনপ্রিয়তা বাড়ছে। আজ আমার এই নিবন্ধে উন্নত তিত করলার চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।

যেভাবে তিত করলা চাষ করবেন

সুনিষ্কাশিত প্রায় সব ধরণের মাটিতে তিত করলা চাষ করা যায়। তবে জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোআঁশ মাটি বা বেলে দোআঁশ মাটিতে এই সবজি চাষাবাদ অত্যন্ত ভালো হয়।

এছাড়া এদেশের আবহাওয়া করলা বা তিত করলা চাষের জন্য উপযোগী। তবে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় করলার চাষের জন্য উত্তম। কারন ছায়াযুক্ত স্থানে তিত করলার ফলন তেমন ভালো হয় না।

জমি তৈরি ও বীজ বপন

করলা চাষের জমি ৩-৪ চাষ ও মই দিয়ে মাটি সমান করে ভালো ভাবে তৈরি করে নিতে হবে। তারপর বেড তৈরি করতে হবে। এছাড়া…

  • বেড চওড়া হবে ১ মিটার; বেডের মাঝে ৩০ সেমি চওড়া নালা তৈরি করতে হবে।

    মারুফ ১ তিত করলা বীজ

    মারুফ ১ তিত করলা বীজ কিনুন 

  • বেড তৈরি করতে হবে জমির সমান লম্বা করে।
  • এরপর ১.৫ মিটার দূরত্বে মাদা তৈরি করতে হবে।
  • বীজ বপনের ৭-১০ দিন আগে মাদায় প্রয়োজন মত সার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে।
  • করলা বীজের আবরন শক্ত তাই বীজ অঙ্কুরোদগম তারাতারি হওয়ার জন্য বোনার আগে পানিতে ভিজিয়ে রাখা উত্তম।
  • প্রতি মাদায় ৩-৪ টি করে বীজ  ২-৩ সেমি গভীর বোনার পর মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
  • মাদায় সরাসরি বীজ বপন না করে পলিব্যাগে ও চারা তৈরি করে বপন করা যায়।

বছর জুড়ে তিত করলার চাষাবাদ করা গেলেও; চারা বা বীজ বোনার উপুযুক্ত সময় হচ্ছে মাঘ-ফাল্গুন এবং বৈশাখ – জ্যৈষ্ঠ। এসময় চারা অথবা বীজ বোনলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। তবে আগাম চাষের জন্য ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বীজ বোনা যেতে পারে।

সার ব্যবস্থাপনা

করলা বা তিত করলা চাষাবাদের জমিতে জৈব সারের প্রয়োগ বিশেষ ভাবে প্রয়োজনীয়। এছাড়া ভালো ফলন পেতে হলে জমিতে অন্যান্য সারও প্রয়োগ করতে হবে।

করলা চাষে সার প্রয়োগ

জমি তৈরি সময় অর্ধেক সার জমি চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। বাকি সার বীজ বোনার বা চারা লাগানোর ১০ দিন আগে মাদায় মাটির সাথে ভালো মিশিয়ে দিতে হবে।

তবে মাটি যদি অম্লীয় হয় তাহলে মাটিতে ৫০-১০০ কেজি ডলোচুন প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিবার সার প্রয়োগ করার পর প্রয়োজন মত সেচ দিতে হবে।

সেচ ও পরিচর্যা

করলা ক্ষেতে প্রয়োজন মত সেচ দিতে হবে। বীজ বোনার সময় খেয়াল রাখতে হবে জমিতে যেন জো থাকে। তবে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে পরাগায়ন বিঘ্নিত হতে পারে। এছাড়া…

  • ক্ষেতে রসের ঘাটতি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে; জমি শুকিয়ে গেলে সেচ দিতে হবে।

    উচ্চফলনশীল ছোট তিত করলা বীজ (হাইব্রিড)

    উচ্চফলনশীল ছোট তিত করলা বীজ (হাইব্রিড)

  • সেচ দেওয়ার পর মাটি চটা হয়ে থাকলে ভেঙে দিতে হবে।
  • সেচের অভাবে গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ফুল ও কচি ফল ঝরে পড়ে।
  • তবে ক্ষেতে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে; প্রয়োজনে নালা দিয়ে অতিরিক্ত পানি সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুণ জমিতে যেন আগাছা না জন্মে।
  •  সেচ ও সার প্রয়োগের পর জো আসা মাত্র নিড়িয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
  • চারা বড় হলে চারার গোড়া থেকে মাঝে মাঝে কিছু ডগা বের হয় সেগুলো ছাটাই করতে হবে।
  • গাছ খুব ঘন থাকলে পাতলা করে দিতে হবে।
  • অধিক ফলনের জন্য করলা ক্ষেতে বাউনি দিতে হবে।
  • মাটি থেকে ১-১.৫ মিটার উচু করে মাচা তৈরি করে দিতে হবে; কারণ মাটির চেয়ে মাচায় তিত করলার ফলন ভালো হয়।

পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন

করলা বা তিত করলায় বিভিন্ন রোগের মধ্যে লিফকার্ল রোগ, ভাইরাস জনিত রোগ, পাতার গুচ্ছ রোগ, ডাউনি মিলডিউ রোগ ইত্যাদি  বেশি দেখা দিতে পারে। জমিতে রোগ আক্রমন করলে প্রয়োজনীয় ছত্রাকনাশক ও বালাই নাশক স্প্রে করতে হবে।

  • করলার কাঁঠালে পোকা– সাইপারমেথরিন জাতীয় বালাইনাশক সকালের পরে সাঁজের দিকে স্প্রে করুন।
  • জাব পোকা– সাদা রং এর আঠালো ফাদ ব্যবহার করুন। তবে, আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন।
  • ফলের মাছি পোকা– সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে পারেন।

এছাড়া……

  • ডাউনি মিলডিউ রোগ– ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে পারেন।
  • পাতা কোঁকড়ানো রোগ– জমিতে বাহক পোকা দমনের জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।
  • মোজাইক ভাইরাস রোগ– জমিতে সাদা মাছি দেখা গেলে (বাহক পোকা) ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।

টবে করলার চাষ

আসুন জেনে নেই কিভাবে  কি ভাবে টবে চাষ করতে হবে…

  • তিত করলা চাষের জন্য মাঝারি বা বড় টব কিংবা ড্রাম ব্যবহার করা উত্তম (হাফ ড্রাম ব্যবহার করা যেতে পারে)।
  • হাফ ড্রামের তলায় কিছু ছিদ্র করতে হবে যাতে অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশিত হয় ।
  • হাফ ড্রামের তলার ছিদ্রগুলো ইটের ছোট ছোট টুকরা দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে ।
  • বীজ বোনার আগে পাত্রের মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
  • করলা বা তিত করলার বীজ বোনার ২৪ ঘন্টা পূর্বে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
  • বীজ বোনার পর মাটি হাত দিয়ে সমান করে দিতে হবে এবং চেপে দিতে হবে ।
  • এই সবজি বীজ বোনার পর এতে নিয়মিত পানি দিতে হবে।
  • তবে খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যেন কখনই পানি জমে না থাকে।
  • তাহলে গাছের গোড়া পচে যেতে পারে।
  • তাই সঠিক নিয়মে পানি দিতে হবে।
  • করলা চাষের ক্ষেত্রে সঠিক ভাবে যত্ন নিতে হবে।
  • গাছ একটু বড় হলে মাচা করে দিতে হবে।
  • গাছে নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে, লক্ষ্য রাখতে হবে এতে যেন কোন প্রকার পোকার আক্রমণ না হয়।
  • এছাড়াও ছাদ সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে । তাহলে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে ।
  • সঠিক পরিমানে সার দিতে হবে।
  • ফলন আসা শুরু করলে সরিষার খৈল পচা, পানি সাথে পাতলা করে গাছে ১৫-২০ দিন অন্তর অন্তর নিয়মিত প্রয়োগ করলে ভালো ফলন পাওয়া যাবে।
  • টব বা ড্রামের মাটি কয়েকদিন পর পর হালকা নিড়ানি দিয়ে আলগা করে দিতে হবে ( যাতে করলা গাছে আগাছা জন্মাতে না পারে)।
  • সেই সাথে মাটি কিছুটা আলগা করে দিলে গাছের শিকড়ের ভাল বৃদ্ধি হয় ।
ফলন ও ফসল সংগ্রহ

বীজ বপনের ৫০-৬০  দিন করলা গাছে ফুল আসা শুরু করে। ফুলে পরাগায়নের ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে ফল খাওয়ার উপযুক্ত হয়।

ফল সংগ্রহ একবার শুরু হলে তা দুমাস পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।  সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করতে পারলে জাত ভেদে প্রতি হেক্টরে প্রায় ৩০ টন ফলন পাওয়া যায়।

 

–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।  বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *