শীতকালীন ফুল হলেও বর্তমানে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালেও গাঁদা ফুল চাষ হয়। বাংলাদেশে গৃহস্থ বাগানের সাধারণ এই ফুল বাগানের শোভাবর্ধন ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান ও গৃহসজ্জায় ব্যাপক ব্যবহার গাঁদা ফুলকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে।
বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে গাঁদা ফুলের চাষাবাদ শুরু হয় ৯০ এর দশক। আজ আমরা এই নিবন্ধে গাঁদা ফুলের সঠিক চাষ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।
গাঁদা ফুল চাষ করবেন যেভাবে ও তার পরিচর্যা
আমাদের দেশে ইনকা, ইয়েলা সুপ্রিম, গিনি গোল্ড, মেরিয়েটা, গোল্ডস্মিথ, ম্যান ইন দ্য মুন, হারমনি, লিজন অব অনার ইত্যাদি জাতের গাঁদা ফুলের চাষাবাদ হয়।
তবে ইদানিং জাম্বো গাঁদা, সাদা গাঁদা, রক্ত বা হাইব্রিড, চাইনিজ, আফ্রিকান ও ফরাসি গাঁদার চাষাবাদও হচ্ছে।
জমি তৈরি
গাঁদা ফুলের চাষের জন্য ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করে নিতে হবে। বর্তমানে সারা বছর এই ফুলের চাষ করা সম্ভব।
সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ, এঁটেল দো-আঁশ ও উর্বর মাটির উঁচু জমি গাঁদা ফুলের চাষাবাদের জন্য উত্তম।
তবে যত্ন করলে সব ধরণের মাটিতেই গাঁদার চাষ করা যায়।
ফরাসী গাঁদা খুবই নিকৃষ্ট মাটিতে ভাল হলেও আফ্রিকান গাঁদা চাষের জন্য পর্যাপ্ত সার দিতে হবে। এছাড়া জমিতে যাতে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো যাতে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
চারা তৈরি ও রোপন পদ্ধতি
- শাখা কলম ও বীজের মাধ্যমে গাঁদা ফুলের চারা তৈরি করা যায়।
- নভেম্বরে বীজতলায় বীজ বপন করে চারা উৎপাদন করতে হয়।
- সারা বছর চাষ করা গেলেও শীতকালে ফলন ভালো হয়।
- শাখা দিয়ে কলম করার জন্য গাঁদা গাছের শাখা ৮-১০ সেমি লম্বা করে কাটতে হবে।
- বীজতলায় শাখা ডালের টুকরাগুলো দুয়েকটি পর্বসহ রোপন করতে হবে।
- রোপনের উপযুক্ত সময় হচ্ছে মার্চ মাস।
- নিয়মিত সেচ দিয়ে বীজতলা ভিজিয়ে রাখলে ২০-২৫ দিনের মধ্যেই পাতা গজায়।
- বীজ বা শাখা থেকে তৈরি একমাস বয়সের চারা ডিসেম্বর মাসে রোপন করতে হয়।
- সারি থেকে সারির দূরত্ব ৪০-৫০ সেমি.
- এবং চারা থেকে চারার দূরত ৩০-৪০ সেমি হওয়া উচিত।
- চারা উৎপাদন না করে সরাসরি বীজ থেকেও গাঁদা চাষ করা যায়।
- এক্ষেত্রে প্রতি শতকে ৫-৬ গ্রাম বীজ জমিতে বপন করতে হবে।
- বীজের মাধ্যমে চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলার মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।
- বীজতলায় নিয়মিত পানি দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে বীজতলায় যেন পানি জমে না থাকে।
- চারাগুলো ১.৫ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি লম্বা হলে আগা কেটে দিলে চারা অতিরিক্ত লম্বা হয় না এবং সবল থাকে।
- এক মাস বয়স হলে চারাগুলো মূল জমিতে রোপণ করা যাবে।
সার প্রয়োগ
গাঁদা ফুলের চাষের জমিতে শতক প্রতি
- পঁচা গোবর ৪০ কেজি,
- ইউরিয়া ২ কেজি,
- টিএসপি ৩ কেজি এবং এমওপি ২ কেজি সার প্রয়োগ করতে হবে।
এ সারগুলো মাটির সাথে মিশাতে হবে। ফুলের মান এবং ভালো ফলনের জন্য দস্তা এবং বোরনও ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া চারা রোপনের ১৫ দিন পর প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
সেচ ও পরিচর্যা
চারা রোপনের ৮ -০ দিন পর্যন্ত কোন কিছু করতে হবে না। তবে গাঁদা ক্ষেতের মাটি শুকিয়ে গেলে সেচ দিতে হয়। গাছের গোড়ায় পানি জমলে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
- এছাড়া নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে।
- গাছ বড় হলে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে; কারণ সোজা গাছের ফুলের গুণগত মান ভালো হয়।
- গাছে ফুলের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য ফুল আসার একমাস আগে গাছের ডগা ভেঙে দিতে হবে।
- একটি শাখায় ঘন হয়ে অনেকগুলো ফুল বা কুঁড়ি ধরলে উপরের একটি বা দু’টি রেখে বাকিগুলো ভেঙে দিতে হবে, যাতে ফুল বড় হয় ‘‘স্টপিং পদ্ধতিতে’’।
- চারা মারা গেলে সেখানে নতুন চারা রোপন করা উচিত।
- তবে চারা ঘন হলেও পাতলা করে দিতে হবে।
স্টপিং পদ্ধতি: রোপণ করা চারা বাড়তে থাকলে ৮ -১০ ইঞ্চি উপরে মাথা কেটে দিতে হবে। পরে যে ডাল বের হবে, তার মধ্য থেকে ২-৩ টি ডাল রেখে তাতে ফুল ফোটাতে হবে। এবং গাছকে যতটুকু পারা যায় খাটো রাখতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন
গাঁদা গাছ অনেক পোকা-মাকড়ের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধী হিসেবে কাজ করে বলে এতে পোকার উপদ্রব নেই বললেই চলে। তবে এতে কিছু রোগের আক্রমণ দেখা যায়, যেমন-উইল্ট, কান্ড পচা ইত্যাদি।
গোড়া পচা রোগ: এই রোগ ছত্রাকের আক্রমণে হয়। ক্ষেতে পানি জমলে গাঁদা ফুলের গাছে গোড়া পচা রোগ বেশি দেখা যায়। গাছের শিকড়ে পচন ধরে; গাছ নেতিয়ে পড়ে ও মরে যায়।
লক্ষ্য রাখতে হবে ফুলের ক্ষেতের গাছের গোড়ায় যেন কোন মতেই পানি জমে না থাকে। রোগাক্রান্ত গাছ সমূলে তুলে তা ধ্বংস করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে টিল্ট বা অনুমোদিত অন্য ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে পারেন।
কান্ড পচা রোগ: এই রোগ ছত্রাকের আক্রমণে হয়। এই রোগ আক্রমণে প্রথমে কান্ডে পানি ভেজা দাগ পড়ে; পরে দাগগুলি একত্রিত হয়ে গাছের কান্ডে পচে যায়; ফলে রোগাক্রান্ত গাছ ঝিমিয়ে পড়ে ও শুকিয়ে মারা যায়।
রোগের আক্রমণ রোধ করার জন্য জমিতে ভাসিয়ে (পস্নাবন) সেচ দেওয়া যাবে না। আক্রমণ বেশি হলে টিল্ট বা অনুমোদিত অন্য ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে পারেন।
এছাড়া গাঁদা গাছ অনেক পোকামাকড়ের বিরুদ্ধেই প্রতিরোধী হিসাবে কাজ করে বলেই পোকার আক্রমণ একদম নেই। তবে অনেক সময় এই ফুলের ক্ষেতে শামুকের উপদ্রব দেখা যায়।
দেখা মাত্রই শামুক তুলের ফেলতে হবে এবং জমিতে চুন ছিটিয়ে শামুক দমন করতে হবে। জাব পোকা আক্রমণ করলে ২ মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন ১ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
টবে গাঁদা ফুল চাষ করবেন যেভাবে
বাড়ির শোভা বর্ধন করতে ছাদের ফুল গাছের রোপনের শখ থাকলে, অনায়াসে গাঁদা ফুল চাষ করতে পারেন। টবে বা ড্রামে গাঁদা ফলের চাষ করলে তিন ভাগ দো-আঁশ, এঁটেল মাটির সাথে প্রয়োজনীয় সার মিশিয়ে মাটি তৈরি করতে হবে।
- এরপর সার মাটি টবে বা ড্রামে কিংবা পলিব্যাগে ভরতে হবে।
- তবে মাটি তৈরির সময় গোবর সার, ভার্মি কম্পোস্ট, কোকোপিট ভাল করে মিশিয়ে নিতে হবে।
- নার্সারি থেকে চারা কিনে আনতে পারেন অথবা বীজ বোনতে পারেন।
- শীতকালীন গাঁদা ফুল গাছ অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থেকে টবে লাগাতে হবে।
- টবের মাটিতে চারা রোপন করে পানি দিতে হবে।
- এরপর চারা প্রথম কয়েক দিন হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে।
- তবে খেয়াল রাখতে হবে টবে বা ড্রামে যেন কোনভাবেই যেন পানি না জমে।
- টবের নিচে ফুটোর জায়গাটি খোলামকুচি দিয়ে চাপা দিয়ে তার ওপরে ছোট ছোট কাঁকড় এবং বালি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে
- যাতে অতিরিক্ত পানি সহজে বেরিয়ে যায়।
- ছাদেতে বা টবে যেখানে উপযুক্ত সূর্যের আলো পড়ে সেখানে গাঁদা গাছ চাষ করতে হবে।
- নিয়মিত সেচ দিতে হবে এবং আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
- প্রচণ্ড রোদে পানি দিলে গাঁদা ফুল গাছের ক্ষতি হতে পারে।
- টবে গাঁদা ফুল চাষ করলে মাঝেমধ্যেই গাছের ডালপালা কেটে দিতে হবে।
- তাতে গাছ ঝাঁকড়া হবে এবং গাছে বড় বড় ফুল দেখা দেবে।
ফলন ও ফুল সংগ্রহ
গাঁদা ফুলের ফলন নির্ভর করে জাত, রোপণ দূরত্ব, সময় ও সার প্রয়োগর উপর। তবে গড়ে জাত ভেদে প্রতিটি গাছে ১৫-৪০টি ফুল ধরে।
কাঁচি বা ব্লেড দিয়ে বোটাসহ ফুল কেটে খুব ভোরে সংগ্রহ করতে হবে।
চারা রোপনের ৩৫-৪০ দিনের মধ্যে ফুল সংগ্রহ করা যায়।
সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে চারা রোপনের ৭০-৮০ দিনের মধ্যেই গাঁদা ফুল সংগ্রহ করা যায়।
–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
আরো পড়ুন …
- জেনে নিন সঠিক অ্যালোভেরা চাষ পদ্ধতি
- সহজ ডাটা শাক চাষ পদ্ধতি
- সহজে আনারস চাষ করবেন যেভাবে
- পান চাষ, জেনে নিন চাষাবাদ পদ্ধতি ও পরিচর্যা
- জেনে নিন সঠিক বাঙ্গি চাষ পদ্ধতি
- সঠিক ও সহজ করলা বা তিত করলা চাষ পদ্ধতি
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।