কৃষি কথা

শীতে একেকটি ছাদ হোক একেকটি ফসলের মাঠ

শীতে একেকটি ছাদ হোক একেকটি ফসলের মাঠ
ফজলুর রহমান
শীত নামছে ধীরে ধীরে। শীত শীত ভাব তো চলেই এসেছে। বাতাসে কমে গেছে আর্দ্রতা। কুয়াশার চাদর মুড়ে দিচ্ছে চারপাশ।
সতসকালে ঘাসের ডগায় দেখা মিলছে মুক্তোর দানার মতোন শিশির।
শীতে প্রকৃতি প্রায় শুষ্ক থাকে। এর প্রভাব সব কিছুর ওপর পড়ে। গাছগুলো এ সময় জীর্ণ হতে পারে। তাই ছাদ বাগান, টব ও গাছের নিয়মিত যত্ন নিতে হবে।
তবে এ সময়টায় ঠিকঠাক এগিয়ে যেতে পারলে একেকটি ছাদ হতে পারে একেকটি ফসলের মাঠ। কি কি গাছ লাগানো যায়, কোন কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে ভালো হয় সে বিষয়ে এবার কথা হোক।

শীতে ছাদবাগানে যেসব গাছ রোপন করবেন

শহুরে জীবনে প্রকৃতির ছোঁয়া পেতে বাড়ির ছাদ কাজে লাগাতে পারেন। আর যদি বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গা থাকে তাহলে তো কথাই নেই।
অনেক বাগানি শীতে রঙিন ফুলের চারা রোপন করে, সাথে সবজিও। শীতকাল বাগান করার সবচেয়ে মোক্ষম সময়। তাই শীতে ছাদবাগানে যেসব গাছ রোপন করবেন জানা প্রয়োজন।
আবহাওয়ার কারণে এই সময়ে গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কসমসসহ নানা রকম ফুল যেমন ফোটে, তেমনি ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, চেরি টমেটো, লেটুসপাতা, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, ক্যাপসিকাম, ব্রুকলি, পালংশাক ও লালশাকসহ নানা রকম সবজি উৎপাদন হয়।
এ ছাড়া চাইলে নানা রকম বিদেশি ফল, ফুল ও সবজির চাষও করতে পারেন।  শীতকালীন ফুলের বীজ, চারা, কলম বা কন্দ রোপণের উপযুক্ত সময় হচ্ছে অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাস।
এখন অনেক নার্সারিতে সব ধরনের ফুল, ফল ও সবজির চারা কিনতে পাওয়া যায়।
সেখান থেকে পছন্দমতো চারা কিনে সহজেই বাসার সামনের খোলা জায়গা অথবা ছাদে শীতের ফুল, ফল বা সবজি চাষ করতে পারেন।
সাধারণত উঁচু দোআঁশ মাটি ফুল, ফল ও সবজি চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
এ জন্য শীতের বাগানে পরিমাণমতো নিয়মিত পানি দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে গাছের গোড়ায় যেন কোনোভাবেই পানি জমে না থাকে।
মনে রাখবেন, বাগানবিলাসে যত বেশি পানি দেবেন তত বেশি পাতা হবে। আর যত কম পানি কিন্তু নিয়মিত পানি দেবেন তত বেশি ফুল হবে।
আবহাওয়ার শুষ্কতার কারণে প্রকৃতিতে এই সময় প্রচুর ধুলাবালি উড়ে বেড়ায়। ধুলাবালি গাছের পাতায় জমে ক্ষতি করে।
এ জন্য গাছের পাতাগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গাছের পাতা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে কোনো রোগবালাই হবে না।
আরো পড়ুন 
গাছকে রোগবালাইমুক্ত রাখতে সহজ একটি পদ্ধতির প্রয়োগ করতে পারেন। দুই লিটার পানিতে দুই ফোটা লিকুইড সাবান [যেমন তরল ডিশওয়াশ] মিশিয়ে সেই মিশ্রণ দিয়ে মাঝে মাঝে পাতাগুলো ধুয়ে দিন।
নিয়মিত এটি করলে মিলিবাগ থেকে শুরু করে গাছের যত রকমের রোগবালাই হয় একটিও হবে না।
মাঝেমধ্যে মাটি খুঁচিয়ে দিন। মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য কেঁচো সার অথবা গোবর ও শুকনা পাতার মিশ্রণ মাটিতে মিশিয়ে দিন। এতে বাগানের ফুল, ফল ও সবজির ফলন খুব ভালো হয়।
টমেটো গাছে যদি টমেটো ধরে, তখন ডালগুলো বাঁকা হয়ে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এ জন্য টমেটো গাছে খুঁটির ব্যবস্থা করতে হবে।
যে বাগানই করুন না কেন নিজের আগ্রহকে প্রাধান্য দিন। এখন যেহেতু শীতের সময়, তাই সবজির বাগান করাই ভালো।
সঙ্গে ফুলের বাগানও করতে পারেন। বাগানে যদি পর্যাপ্ত জায়গা থাকে তবে ড্রাগন, পেয়ারা, বেদানার চারা লাগাতে পারেন। এতে সারা বছর ফল পাওয়া যাবে। বাগানের প্রতি আপনার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে।
যেকোনো বাগানের তিনটি প্রধান উপকরণ হলো পানি, মাটি ও সূর্যের আলো। ফুল, ফল ও সবজি পাওয়ার জন্য শীতকাল উপযুক্ত একটি সময়।
কারণ, মাটির পিএইচ বা গুণাগুণে ভারসাম্য ও শীতের ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে মাটির আর্দ্রতা বেশি সময় থাকে।
শীতকালে ছাদবাগানের পরিচর্যা অন্য যেকোনো সময় থেকে একটু বেশি নিতে হবে। শীতের সময় হঠাৎ তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমে যাওয়া বা অতিরিক্ত কুয়াশায় মাটিজনিত রোগ খুব দ্রুত ছড়ায়।
মাটিতে বিভিন্ন রকম ক্ষতিকর পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়।
এ ছাড়া শীতকালীন গাছে বৃদ্ধি বেশি হয়। ফুল, সবজি ও ফলের ফলনও হয় অল্প কিছুদিনের মধ্যে। এ ছাড়া অন্য ঋতুর গাছগুলোও বেশ ঝুঁকিতে থাকে। প্রতিদিনই এ কারণে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

যা যা করবেন , যা যা করতে মানা-

  • শীতে সবজি ও ফলের জন্য সারের ব্যবহার একটু বেশি দরকার। কারণ, গাছের বৃদ্ধি ও ফল দেওয়ার কারণে গাছের খাদ্য বেশি প্রয়োজন হয়। ফুল গাছে তুলনামূলক কিছুটা কম সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • সঠিক সময়ে ও পরিমাণমতো সার প্রয়োগ একান্ত প্রয়োজন। গাছ লাগানোর ১৫ থেকে ২০ দিন পর যখন গাছ ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি লম্বা হবে, তখনই সার প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া গাছে ফল ধরার আগে বা ফুল ধরলে আরও একবার সার প্রয়োগ করতে হবে।
  • শীতকালে গাছে জৈব সার বা কেঁচো সার ব্যবহার করুন। এতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। যেহেতু এই সারে কোনো রাসায়নিক পদার্থ থাকে না, তাই ফল ও সবজির পুষ্টিগুণ বজায় থাকে।
  • শীতকালীন গাছ ছাড়া অন্যান্য গাছ এ সময়ে বাড়ে কম। তাই গাছ ছাঁটাইয়ের একেবারেই প্রয়োজন নেই এই সময়ে। শুরুতে গাছের আগাছা ফেলে পরিষ্কার করে নিতে হবে অবশ্যই।
  •  সকালে ও বিকেলে পানি দেওয়াই ভালো। এক বেলা দিলে বিকেলের সময়টাই বেছে নিতে হবে। তবে টবে পানি জমে থাকতে দেওয়া যাবে না কখনোই।
  • শীতে মাটির ছত্রাকজনিত রোগ যেহেতু বেশি ছড়ায়, তাই শীতের শুরুতেই নতুন মাটিতে ছত্রাকরোধী কীটনাশক মিশিয়ে গাছের গোড়ায় ব্যবহার করতে হবে। গাছের পাতাতেও প্রয়োজনে স্প্রে করে নিতে পারেন। অন্তত মাসে দুবার প্রয়োজনীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
  • গাছের মাটি থেকে আর্দ্রতা যেন বেরিয়ে যেতে না পারে, তাই শুকনো পাতা বা খড় দিয়ে গোড়া ঢেকে দিন। এতে গাছের গোড়ায় বেশি কুয়াশাও লাগবে না, আবার আর্দ্রতাও বজায় থাকবে।
  • কোনো গাছে পোকা আক্রমণ করলে সঙ্গে সঙ্গে তা তুলে ফেলুন। কারণ, শীতে এই ধরনের পোকা দ্রুত অন্য গাছের ক্ষতি করে।
  • শীতে সূর্যের আলো যেহেতু কম থাকে, গাছের সালোকসংশ্লেষণ ভালো হওয়ার জন্য রাতে একটু গরম লাইটের ব্যবহার করা যেতে পারে।
  • শীতে অনেক সময়ে পচন রোগ দেখা দেয়। সেই অংশটি কেটে ফেলুন বা প্রয়োজনে পুরো গাছ তুলে ফেলুন।
  • সবজি ও ফল গাছের ফল যখন ৯০ ভাগ পরিপূর্ণ হবে, তখন তুলে ফেলা ভালো।
  • শীতকালে কাট ওরম, মিলিবাগ, ফ্রুট ফ্লাই, ফ্রুট বোরের, শ্যুট বোরের ইত্যাদি ছত্রাক ও ভাইরাসজনিত রোগ হতে পারে। ছাদবাগানের গাছে এই ধরনের রোগ প্রতিকারের জন্য সাইপারমেথরিন, ম্যানকোজেব ও মালাথিওন জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। 
সারা বছর ছাদবাগান না করলেও শীতে অনেকেই ছাদবাগানে আগ্রহী হন। আবার আগে থেকেই যাঁদের ছাদবাগান রয়েছে, তারাও শীতের ফুল, ফল ও সবজি গাছ লাগান।
ছাদবাগানের পরিবেশ হয় অন্য যেকোনো বাগানের থেকে অনেকটাই আলাদা।
তাই শীতকালেও ছাদবাগানে পূর্ণতা আনতে দরকার বিশেষ যত্নের। সকলে যে যার ছাদ কাজে লাগাতে পারি। এভাবে পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি মনের তুষ্টির এন্তেজাম করতে পারি।
লেখক: উপ-পরিচালক, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *