যেভাবে ছাদ বাগান বা টবের মাটি তৈরি করবেন

ইদানিং বাংলাদেশ ছাদ বাগানির সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে টবের মাটি তৈরি করার সঠিক পদ্ধতি জানা না থাকার কারনে অনকেই সফল হতে না পেরে; উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।

টবের জন্য মাটি প্রস্তুত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাছে দ্রুত বৃদ্ধি ও ভালো ফলনের জন্য ছাদ বাগানের টবের জন্য মাটি তৈরির সঠিক নিয়ম জানা থাকা জরুরী।

কারন মাটি ভালো না হলে গাছের বৃদ্ধি ও ভালো ফলন পাওয়া কার্যত অসম্ভব। তাই আজ আমরা এই নিবন্ধে সহজ উপায়ে টবের মাটি তৈরির পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব। 

ছাদ বাগানের টবের মাটি তৈরি করার সহজ পদ্ধতি জেনে নিন

ছাদে বাগানের টবের জন্য শুধু মাটি হলেই হবে না, দরকার গাছের উপযোগি ও সঠিক মাটি। ছাদ বাগানের মাটি যেমন হবে…

  • বেলে-দোঁআশ; ছাদে বাগান করার সবচেয়ে উপযোগি মাটি।
  • তবে এই মাটি ছাদ বাগানের উপযোগি করার জন্য মাটির সাথে গোবর সার, পাতা পচা সার, কাঠ পোড়ানো ছাই, সরিষার খৈল, টিএসপি, পটাশ, পাথর চুন ইত্যাদি মেশাতে হবে।
  • এছাড়া ছাদে বাগানের উপযোগি করতে এঁটেল মাটির (শক্ত মাটি) সাথে বালি মাটি মেশাতে হবে।
  • আর মাটি যদি বালি হয়, তাতে এঁটেল মাটি মিশিয়ে দো-আঁশ মাটিতে রূপান্তর করতে হবে (মাটি ঝুর ঝুরে হলেই বুঝবেন তা দো-আঁশ মাটি)।

টবে জৈব সারের ব্যবহার, জেনে নিন তৈরি ও প্রয়োগ পদ্ধতি

গাছের বৃদ্ধি ও ভালো ফলনের জন্য সব ধরনের মাটিতে প্রচুর পরিমাণে (চারভাগের একভাগ) জৈব সার মেশাতে হবে।

টবের জন্য ভার্মিকম্পোস্ট সবচেয়ে উপযোগি জৈব সার;  এছাড়া গোবর সার, পাতা পচা সার, কাঠ পোড়ানো ছাই, সরিষার খৈল, বাড়িতে তৈরি আবর্জনাও জৈব সার হিসাবে ব্যবহার করা যায়।

জৈব সারের পরিমাণ…   

  • ৩ বস্তা মাটির সাথে ১ বস্তা গোবর সার;
  • পাতা পচা সার (যদি থাকে) অর্ধেক বস্তা;
  • ১ কেজি কাঠ পোড়ানো ছাই (যদি থাকে);
  • সরিষার খৈল ৩০০ গ্রাম;
  • ২০০ গ্রাম খাঁটি নিম খোল;
  • হাড়ের গুঁড়ো ২০০ গ্রাম;
  • ৫০ গ্রাম পাথর চুন।

এঁটেল বা বালি মাটি হলে এর পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। মাটির অর্ধেক পরিমাণ হলে ভালো হয়।

জৈব সারের ব্যবহারের নিয়ম…  

গোবর সার: নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম পাওয়া যায় গোবর সার থেকে। তবে কখনো কাঁচা ও শুকনো গোবর প্রয়োগ করা যাবে না।

গোবর পচিয়ে তারপর প্রয়োগ করতে হবে।

শুকনো গোবর সংগ্রহ করে পানি দিয়ে হালকা ভিজিয়ে রাখার পর গন্ধ চলে গেলে, গাছের গোড়া থেকে সামান্য দূরে প্রয়োগ করতে হবে।

এবাবে  ১৫ দিন পরপর এই জৈব সার প্রয়োগ করা যাবে।

ভার্মিকম্পোস্ট:  বিশেষ প্রজাতির লাল কেচো দ্বারা গোবর পচিয়ে এ সার তৈরি করা হয়। এই সারের পুষ্টি উপাদান গোবর সারের চেয়ে বেশি; ভার্মি কম্পোস্ট প্রয়োগ পদ্ধতি গোবর সারের মত।

টবের মাটিতে ইউরিয়া সারের পরিবর্তে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করা যায়।

সরিষা ও নিমের খৈল: এতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়ামের পাশাপাশি গাছের জন্য প্রয়োজনীয় গৌণ পুষ্টি উপাদানও রয়েছে।

এছাড়া নিমের খৈলেও একই ধরনের উপাদান পাওয়া যায়। তবে নিমের খৈল মাটি থেকে ফাংগাস, ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে।

  • ১০০ গ্রাম খৈল ১ লি. পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে ১-৩ দিন।
  • পরে পানি গুলো টবের কিনারা বরাবর প্রয়োগ করতে হবে।
  • এছাড়া সরিষা ও নিমের খৈল গুড়ো করে মাটির সাথে মিশিয়ে হালকা পানি ছিটিয়ে রাখতে হবে ৩০ মি.।
  • ৩ সপ্তাহ পরপর প্রয়োগ করা যাবে।

চা পাতা: চা পাতায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম আছে। তাই, ব্যবহার করা চা পাতা ফেলে না দিয়ে; রোদে শুকিয়ে গুড়া করে টবে প্রয়োগ করতে পারেন।

ডিমের খোসা: অল্প কয় দিন রোদে শুকিয়ে ডিমের খোসা পিষে গুড়ো করে গাছের গোড়ায় প্রয়োগ করতে হবে।

কলার খোসা: প্রচুর পরিমাণে পটাশ এবং সামান্য পরিমাণ জিংক,ম্যাংগানিজ,আয়রন/লৌহ থাকে কলার খোসায়।

  • এটি রোদে শুকিয়ে পিষে গুড়ো বা খোসা ৩ দিন পানিতে ভিজিয়ে পানি ছেকেও প্রয়োগ করতে পারেন।
  • কালার খোসা গাছে ফুল আসার আগে বেশি ও ফুল ফোটার পরে সামান্য প্রয়োগ করতে হবে।

চা পাতা, ডিমের খোসা, ও কলার খোসা ১ঃ১ঃ১ অনুপাতে একসাথে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যায়। তাহলে গাছের জন্য অপরিহার্য তিনটি উপাদান নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়ামের  অভাব পূরণ হবে।

ফিস মিলঃ নাইট্রোজেন এবং ফসফরাসের পাশাপাশি  প্রচুর গৌণ উপাদান এবং এমিনো এসিডস রয়েছে ফিস মিলে।

  • ফল জাতীয় গাছে টবের মাটি তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।
  • এরপর টবে এক মাসে ১ বার করে প্রয়োগ করা যাবে।

বোন মিলঃ ফসফরাস ক্যালসিয়াম এবং সামান্য নাইট্রোজেন রয়েছে হাড়ের গুরা বা বোন মিলে। এটি প্রয়োগ করতে হবে ৪ মাস পরপর।

ছাদ বাগান বা টবে চারা বা বীজ লাগালোর শুরুর দিকে ১৫ দিনে একবার; এরপরে মাসে ১ বার করে জৈব সার প্রয়োগ করা উত্তম।

তবে মনে রাখতে জৈব সার গাছের গ্রহণ উপযোগী হতে ৭ থেকে  ১৫ দিন সময় লাগে।

টবের গাছে রাসায়নিক সার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকা উচিত; কারন জায়গা ছোট হওয়ায় ক্ষতিও বেশি করে গাছের।

প্রথম দিকে ভালো হলেও রাসায়নিক সারের ব্যবহার কিছুদিন পর গাছ ও মাটির স্বাস্থ্য একেবারে নষ্ট হয়ে যায়; পরে তা আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় না।  সুত্র – e-krishi Clinic

টবে রাসায়নিক সার মেশানোর নিয়ম

টবের মাটিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ খুব জটিল বিষয়; কারন সারের বেশি হলে গাছ মরে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে।

তাই, টবে রাসায়নিক সার ব্যবহারের বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথেই নিতে হবে, সব ধরনের রাসায়নিক সার পানির সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা উত্তম।

রাসায়নিক সার প্রয়োগের নির্দিষ্ট মাত্রা

ছাদের জন্য হাফ ড্রাম এবং মাটির জন্য ২.০ ফুট × ২.০ ফুট × ১.৫ ফুট আকারের গর্তের জন্য প্রায় ১২০-১৫০ কেজি (৩-৪ বস্তা প্রায়) মাটি হিসাব করে।

  • উভয়ক্ষেত্রে মাটির সাথে টিএসপি ১২০-১৫০ গ্রাম (৩-৪ মুঠ প্রায়);
  • পটাশ ৮০-১০০ গ্রাম (২-৩ মুঠ প্রায়);
  • জিপসাম ৪০-৫০ গ্রাম (১.০-১.৫ মুঠ প্রায়);
  • ১০-১৫ গ্রাম (১.৫- ২.০ চা চামচ প্রায়) করে বোরণ ও দস্তা সার ভালোভাবে মিশিয়ে ১৫ দিন ঢেকে রাখতে হবে।
  • ১৫-২০ দিন পর মাটি পুনরায় ভালোভাবে মিশিয়ে কয়েকঘন্টা খোলা রেখে, তারপর চারা বা বীজ বপন করবেন।
  • ইউরিয়া সার চারা রোপণের পর ভালোভাবে লেগে গেলে কয়েক কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।

এছাড়া চারা বপনের ২০ থেকে ২৫ দিন পর প্রতি মাসে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে পারেন যেভাবে…

প্রতিবার এক লিটার পানিতে হাফ চা চামচ করে ইউরিয়া (সাদা সার) + এমওপি/পটাশ (লাল সার) + টিএসপি (মেটে সার) এবং এক চিমটি করে সালফার অথবা বোরণ দুটোর যেকোন একটি দিতে পারেন।

সার গুলো ভালোভাবে পানির সাথে মিশিয়ে প্রয়োজনমত গাছের গোড়ায় ঢেলে দিতে হবে। মাটি ভেজা থাকলে শুকানোর পর গোড়ায় দিবেন।

যেভাবে টবে মাটির শোধন করবেন

টবে তৈরির সময় মাটি শোধন করে নেওয়া উত্তম। এর জন্য যা করতে হবে বাগানীদের

  • টবের মাটির সাথে ১০ গ্রাম (১.০-১.৫ চা চামচ) হারে দানাদার কীটনাশক এবং কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক মিশিয়ে মাটি শোধন করে নিতে পারেন।
  • এতে করে নেমাটোড বা কৃমি এবং ছত্রাক দমন করা অনেকটা সম্ভব।
  • এছাড়া জৈব কীটনাশক বায়োডার্মা সলিড ব্যবহার করতে পারেন; সে ক্ষেত্রে প্রতি কেজি ভার্মিকম্পোস্টের সঙ্গে ১-২ গ্রাম হারে বায়োডার্মা মিশিয়ে ১৫ দিন রেখে দিতে হবে।
  • এর পর (১৫ দিন পর) সার মিশ্রিত মাটির সঙ্গে বায়োডার্মা মিশ্রিত ভার্মিকম্পোস্ট মেশাতে দিতে হবে।

ছাদ বাগানের টবের জন্য আদর্শ মাটি এভাবে তৈরি করা সম্ভব। হাতে সময় থাকলে এভাবে মাটি তৈরি করে চারা বা বীজ লাগানো ভালো;  সময় না থাকলে শুধুই জৈব সার মিশিয়ে চারা লাগানো যায়।

টবের মাটি যেভাবে গাছ লাগানোর উপযোগি হবে
  • প্রথমে তৈরি করা মাটি শুকিয়ে ঝুরঝুরে করে নিবেন।
  • এরপর টবের নিচে প্রথমে পাথর বা ইটের খোয়া বা খোলন কুচি দিয়ে তার উপর ২ ইঞ্চি পরিমান বালু দিয়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা করে নিতে পারেন ( টবে অবশ্যই ছিদ্র থাকতে হবে)।
  • তার উপর সার মিশানো মাটি দিয়ে টব ভরাট করে নিতে হবে।
  • এবার টবের মাটিতে পানি দিয়ে টব পলিথিন দিয়ে ৫ থেকে ৭ দিন বেধে রাখবেন।
  • এর মধ্যে টবে বীজ বা চারা লাগানো উপযোগী হয়ে যাবে।

তবে বীজ ছোট অন টাইম কাপে, সীডলিং ট্রেতে বা বীজ তলায় আগে চারা করে নিলে পরে সেই চারা টবে রোপন করলে উত্তম।

টবের মাটিকে কেঁচো, শামুক ও পিঁপড় থেকে দূর করার উপায়

মাটি তৈরি সময় পরিমান মত নিম খৈল মাটির সাথে মাশিয়ে দিলে কেচো, শামুক ও পিঁপড়ার উপদ্রব কমে যাবে।

পরবর্তীতে ১ থেকে ২ চামচ নিম খৈল ১৫ দিন অন্তর অন্তর টবের চারিপাশে ছড়িয়ে দিলে কেঁচো, শামুক ও পিঁপড় সম্যসার দূর হবে।

  • এছাড়া ডিমের খোসা গুড়া করে টবের চারিপাশে ছড়িয়ে দিলে বা মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে কেঁচো, শামুকের উপদ্রব অনেক অংশে কমে যায়।
  • ৫ গ্রাম কার্বোফুরান গ্রুপের কীটনাশক টবের চারিপাশে ছড়িয়ে দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিন কেঁচো, শামুক, পিঁপড়ে ও নেমাটোড দূর করতে পারেন।
  • কয়েক টুকরা শসা লম্বা লম্বি করে কেটে সারা রাত রেখে দিলে সকালে দেখবেন শামুক জড়ো হয়ে আছে। শামুক সহ শসা ফেলে দিলে শামুক চলে যাবে।
  • টবের চারিপাশে শুকনো মরিচ গুরা ছিটিয়ে দিলে কেচো, শামুক ও পিঁপড়ে দূর হবে।
 ছাদ বাগানের টবের মাটি ভালো রাখার ৪ কৌশল
  •  জৈব সার ব্যবহার করুন: আস্তে আস্তে মাটির গুণমান উন্নত করতে টবের মাটির সাথে জৈব সার ব্যবহার করতে পারেন।
  • কম্পোস্ট করার চেষ্টা করুন:কম্পোস্টিং-এর সবচেয়ে ভাল দিক, এটি জৈব পদার্থের দ্রবণীয় পুষ্টিকে স্থিতিশীল করে এবং মাটিতে হিউমাস গঠন করে।
  • আগাছা দমন: আগাছা টবের মাটির উর্বরতা নষ্ট করে; এতে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এজন্য টবে আগাছা যাতে না জন্মায় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  •  সেচ ও সুষ্ঠু পানি  নিষ্কাশন ব্যবস্থা:  শুষ্ক মৌসুমে টবে নিয়মিত সেচ দিতে হবে। তবে বৃষ্টি সময় খেয়াল রাখতে হবে টবে যেন অতিরিক্ত পানি না জমে।

প্রিয় বাগানী, টবের মাটি নিয়ম মেনে তৈরি করতে অনেক ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। এছাড়া গাছের যতাযত বৃদ্ধি ও ভালো ফলনের জন্য প্রতি বছর টবের মাটি আংশিক পরিবর্তন করা উত্তম।

বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?