বর্তমানে বারোমাস সজনে বা সজিনা চাষ করা যায়। সার ও কীটনাশক ছাড়া বিনাযত্নে সম্পূর্ণ লাভজনক সজিনা বা সজনের চাষাবাদ। একবার লাগালেই হলো।
বারোমাসি সজিনা গাছ সারা বছরই ফলন দেয়। এজন্য সজিনার চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন চাষিরা।
এদিকে কম খরচে অধিক লাভের কারণে সজিনা চাষে ঝুঁকছে কৃষকরা। তাই, আজ আমরা এই নিবন্ধে সজিনার চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।
ODC3 সজিনা বা বারোমাসি সজিনা চাষ পদ্ধতি
২০১৯ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের যশোর হর্টিকালচার সেন্টারে বারোমাসি সজিনার চাষাবাদ উৎপাদন ও বিতরণ শুরু হয়।
সর্বপ্রথম চকঝ-২ জাতের এ বারোমাসি সজিনা গবেষণার মাধ্যমে চট্টগ্রামের রাইখালীতে অবস্থিত কৃষি গবেষণা কেন্দ্র হতে উদ্ভাবন হয়।
এ জাতের সজিনা মাটিতে চারা বপনের ৬ মাসের মধ্যে গাছে ফল বা ডাটা ধরবে এবং সারা বছরই তা পাওয়া যাবে।
মাটি নির্বাচন ও জলবায়ু
সব ধরণের মাটিতে সজিনা চাষ করা যায়। তবে পলিমাটি এবং বেলে দোআঁশ মাটি সর্বোত্তম। সজিনা জলাবদ্ধতা একদম সহ্য করতে পারে না; তাই চাষাবাদের জন্য উঁচু জমি নির্বাচন করা উচিৎ।
- তবে, সজিনা চরম প্রাকৃতিক অবস্থা সহ্য করতে সক্ষম।
- ২০-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সজিনা চাষের জন্য উপযোগী।
- ২৫০-১৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় এমন এলাকায় এই গাছ ভাল জন্মায়।
সজিনা চাষের জন্য প্রথমে জমি ভালোভাবে চাষা বা মাই দিয়ে জমি তৈরী করে নিতে হবে। সজিনা চাষের জমিতে সব সময় সেচের ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সজিনার চারা তৈরি ও বপন
এপ্রিল-মে মাস সজনে বা সজিনার কাটিং বা চারা বপনের উপযুক্ত সময়। বীজ থেকে বংশবিস্তার সম্ভব হলেও অঙ্গজ বা কাটিং থেকে নতুন চারা তৈরি করাই সবচেয়ে উত্তম।
বীজ থেকে চারা তৈরি
- বোনার আগে বীজ কয়েক ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- এতে বীজ থেকে দ্রুত চারা গজাবে।
- বীজ থেকে চারা বের হতে সময় লাগে ১০-১৫ দিন।
- জুন-জুলাই মাসে চারার বেড ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হবে।
- বেডের আকার ১ মিটার প্রস্থ ও জমির আকার অনুযায়ী লম্বা হতে পারে।
- তবে বেডের চতুর্দিকে পানি নিষ্কাশনের জন্য ৩০ থেকে ৫০ সেমি. ড্রেন রাখতে হবে।
- বেডে ১০-১৫ সেমি. দূরে দূরে লাইন করে বীজ বোনতে হবে।
- ৫০-৬০ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হয়।
- চারা গজানোর থেকে শুরু করে চারা উঠানো পর্যন্ত বেড আগাছামুক্ত ও সেচ প্রদান করতে হবে।
- কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই দমনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
- তবে বীজ থেকে তৈরি চারার ফল আসতে ৩-৪ বছর সময় লাগে।
কাটিং হতে চারা তৈরি
- কাটিং থেকে সজনে বা সজিনা চার তৈরি করাই উত্তম।
- এক্ষেত্রে অল্প যতে দ্রত ফলন পাওয়া যায়।
- আমাদের দেশে ডাল পুঁতে অঙ্গজ উপায়ে চার তৈরির পদ্ধতিটি বেশি বহুল প্রচলিত।
- কারণ হল এটি করতে তেমন দক্ষতার প্রয়োজন হয়না আর খরচও কম।
- প্রস্তুতকৃত কাটিং সরাসরি মূল জমিতে বপন করতে হবে।
- কাটিং বপনের উত্তম সময় এপ্রিল-মে মাস।
বয়স্ক গাছ থেকে প্রুনিং এর সময় যে ডাল কেটে ফেলা হয় তা থেকে রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত সতেজ ও স্বাস্থ্যবান শক্ত ডাল ২.৫-৩ ফুট (৭৫-৯০ সেমি.) লম্বা ও ৩-১৬ সেমি. ব্যাস বিশিষ্ট ডাল নির্বাচন করতে হবে।
কাটিং রোপণ পদ্ধতি
- জমি ভালোভাবে তৈরি করে ২০ ইঞ্চি-২.৫ ফুট × ২০ ইঞ্চি-২.৫ ফুট × ২০ ইঞ্চি-২.৫ ফুট আকারের গর্ত করতে হবে।
- লক্ষ রাখতে হবে যে, কাটিং গর্তে লাগানোর সময় প্রতিটি কাটিং এর তিন ভাগের এক ভাগ গর্তের মাটির নিচে রাখতে হবে।
- কাটিং লাগানোর সময় গর্তের মাটির থেকে ৩-৪টি নিমপাতা এবং ১০ গ্রাম সেভিন ৮৫ ডবি উপি গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে কাটিং লাগালে মাটিতে পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়।
- গর্তে কাটিং লাগানোর পর কাটিংয়ের মাথায় আলকাতরা দিয়ে প্রলেপ দিতে হবে (এতে কাটিংয়ের মাথা শুকিয়ে যাবে না)।
সজিনা গাছের চারা লাগানোর সাথে সাথে সজিনার চারার সাথে খুঁটি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে, যাতে গাছ হেলে না পড়ে। এছাড়া কাটিং লাগানোর সময় লক্ষ্য রাখতে হবে ডালটি গাছে থাকা অবস্থায় এর আগা বা মাথা এবং গোড়া যে দিকে ছিল রোপণ করার সময় যেন ঠিক সেই ভাবেই থাকে।
সার প্রয়োগ
সজিনার ভালো ফলন পাওয়ার জন্য প্রতি গর্তে…
- গোবর/কম্পোস্ট ৪০-৫০ কেজি (অর্ধেক অংশ সজনের চারা রোপনের আগে এবং অর্ধেক অংশ পরে)।
- টিএসপি ৫০ গ্রাম।
- ইউরিয়া ১০ গ্রাম, এমওপি/পটাশ- ১০০ গ্রাম।
- জিপসাম- ১০ গ্রাম।
- দস্তাসার-১০ গ্রাম ও বোরন সার- ১০ গ্রাম সার প্রয়োগ করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, গোবর সার ছাড়া বাকি সবগুলো সার সজনের চারা রোপনের পর প্রয়োগ করতে হবে।
পরিচর্যা ও সেচ ব্যবস্থা
- সজিনা গাছের তেমন একটা পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না।
- তবে সজনে গাছের গোড়া সব সময় আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।
- শুধু গরু ছাগলের উপদ্রব ঠেকানো সম্ভব হলেই সজিনা গাছগুলো বড় হয়ে ওঠে এবং তাতে ভালো ফলন হয়।
- মাটির উপর সার ও কীটনাশকের খুব একটা প্রয়োজন হয় না। কারণ সজিনার বিস্তৃত ও গভীর শিকড় রয়েছে।
- তবে ইউরিয়া এবং জৈব সার প্রয়োগ করলে গাছ ভাল হয়।
- সজনে গাছ যে কোনো পতিত জমি, পুকুর পাড় রাস্তা বা বাঁধের ধারে যে কোনো ফাঁকা জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে লাগানো যায়।
- চারা রোপণ করলে প্রথমে ১০ সেমি. আগা কাটতে হবে।
- দ্বিতীয় বার ডগা বের হলে তা ২০ সেমি. পর কেটে ফেলতে হবে।
- পছন্দসই ডগা রেখে বাকিগুলো সব কেটে ফেলতে হবে।
- এতে করে গাছের আকৃতি ঝোপালো, ফলন বেশি এবং ফল সংগ্রহ সুবিধা হবে।
- নতুবা লম্বা ডালে অল্প সজিনা হবে যা পাড়তে গেলে ডাল কাটতে হবে।
- সজিনা গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সজনে গাছের মরা এবং অপ্রয়োজনীয় ডালপালাগুলো ছেঁটে দিতে হবে।
নতুন লাগানো গাছে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শীঘ্রই শিকড় গজাতে পারে। শুষ্ক ও রৌদ্রজ্জ্বল সময়ে প্রায় দুই মাস সেচ দিতে হবে।
টবে বা ছাদ বাগানে সজিনা চাষ
সজনে বা সজিনার উপকারিতা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানিনা। অসাধারণ এই গাছে চাষ করুন; বাগানে উঠানে যদি জায়গা থাকে তাহলে সেখানেই লাগাতে পারেন।
কিন্তু বর্তমান যুগে আমরা অনেকেই ফ্ল্যাটে থাকি, আর সেখানে বাগান খুব একটা দেখা যায় না। তাই ব্যালকনি কিংবা ছাদে টবেই চাষ করতে পারেন সজনের।
- টবে বা ছাদ বাগানে সজিনা চাষে জন্য ২০ ইঞ্চির টব, কিংবা জলের জায়গা, বড় ড্রাম যেকোনো কিছু বেছে নিতে পারেন।
- প্রতিকূল পরিবেশে খুব সহজেই বেড়ে উঠতে পারে সজিনা।
- এ গাছ চাষের জন্য বেলে-দোআঁশ যুক্ত টব তৈরি করুন।
- এতে উপযুক্ত পরিমাণে গোবর সার মিশিয়ে নিন মাটি প্রস্তুত করতে হবে।
- এই গাছের রোগবালাই খুব একটা হয়না, তবে মাটি প্রস্তুত করার সময় নিন খোল মিশিয়ে নিতে পারেন।
- এই গাছের জল খুব একটা প্রয়োজন হয় না। বেশি জল হলে গাছ মরে যেতে পারে।
- উপরের মাটি শুকিয়ে গেলে তবেই আস্তে আস্তে জল দিন। সাত-আট ঘণ্টা রোদের মধ্যে থাকতে পারে এই গাছ।
- দশ দিন অন্তর অন্তর গাছের গোড়ায় সরষের খোল পচা তরল সার দিতে পারেন।
ফলন ও ফসল সংগ্রহ
কাটিং হতে প্রাপ্ত গাছ থেকে ১ বছর পরেই সজিনার ফলন পাওয়া যায়। একটি পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে ১৬০০টি পর্যন্ত সজিনার ফল বা ডাটা উৎপাদন হবে।
বারোমাসি চারা লাগানোর ৬ মাস পর থেকে ফল ধরবে এবং তা সারা বছর পাওয়া যাবে।
–লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
আরো পড়ুন …
- সাম্মাম বা রকমেলন চাষ পদ্ধতি
- সঠিক শালগম চাষ পদ্ধতি
- জেনে নিন আধুনিক ক্যাপসিকাম চাষ পদ্ধতি
- আধুনিক স্ট্রবেরি চাষ পদ্ধতি
- জেনে নিন উন্নত সরিষা চাষ পদ্ধতি
- যেভাবে সহজে পুঁইশাক চাষ করবেন
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।