কৃষি কথা

সহজ আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি

সহজ আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি

ইদানিং বিদেশি ফল আঙ্গুর চাষ এ সাফল্য পাচ্ছে বাংলাদেশের চাষীরা।

শহর থেকে গ্রামাঞ্চল সর্বত্রই জনপ্রিয় এই বিদেশি ফল চাহিদা থাকলেও; চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকাসহ নানা কারণে চাষের আগ্রহ চাষীদের মাঝে খুব একটা দেখা যায়নি।

তবে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে আঙ্গুরের চাষাবাদে সফল হওয়া সম্ভব ব্যাপক, এমনটা জানাল কৃষি কর্মকর্তারা ও চাষীরা।

তাই এই নিবন্ধে আমরা আঙ্গুর চাষের পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

যেভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে খুব সহজে আঙ্গুর চাষ করবেন

বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া আঙ্গুরের চাষাবাদের উপযোগি; পরিমিত মাত্রায় সার ও সঠিক পরিচর্যায় জনপ্রিয় এই বিদেশি ফল ফলন দিতে পারে বছরের পর বছর ধরে।

আঙ্গুর চাষরের জন্য সুনিষ্কাশিত সর্বদা আলো-বাতাস পায় এমন এঁটেল এবং দো-আঁশযুক্ত লালমাটি, জৈবিক সার সমৃদ্ধ কাঁকর জাতীয় মাটির জমি উপযুক্ত।

  •  তবে মাটি মান ৬.৫ থেকে ৭,৫ পর্যন্ত pH হওয়া সবচেয়ে উত্তম।
  • জমি অবশ্যই উঁচু হতে হবে যেখানে পানি দাঁড়িয়ে থাকবে না।
  • প্রচুর সূর্যের আলো পায় এমন জমি আঙ্গুরের চাষাবাদের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

আমাদের দেশে অক্টোবর থেকে নভেম্বরে আঙ্গুরের গাছ ছাটাই করলে মার্চ-এপ্রিল মাসে ভালো ফলন পাওয়া যায়। এরপর আবার শীতের সময়ে ফল আসে।

জমি তৈরি ও বীজ বপন

উচ্চফলনশীল লাল আঙ্গুর বীজ

উচ্চফলনশীল লাল আঙ্গুর বীজ কিনুন

বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে আঙ্গুর চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় মার্চ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত।

তবে বীজ বোনার উপযুক্ত সময় হচ্ছে বসন্তের শুরু থেকে শীতকাল পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে বীজ বপন সম্ভব না ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করা উত্তম।

  • আঙ্গুরের বীজ বপন বা চারা লাগানোর আগে চাষের জমিতে ৪০ × ৪০ × ৪০ সে. মি. মাপের গর্ত করে তাতে প্রয়োজন মত সার মিশিয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন রেখো দিতে হবে।
  • যেন সারগুলো ভালোভাবে মাটির সাথে মিশে যায়।
  • তারপর চারা রোপন করলে, চারা লাগালোর পর হালকা সেচ দিতে হবে।
  • বীজ বোনালে; বোনার আগে ২৪ ঘন্টার মত এক গ্লাস পানিতে বীজগুলো ভিজিয়ে রাখতে হবে।
  • এরপর প্রতি গর্তে ৩-৪টি বীজ সেন্টিমিটার গভীরে বপন করতে হবে।
  • তবে লক্ষ্য রাখতে হবে খুব বেশি চাপ না দিয়ে বীজ দেওয়া গর্তগুলো ভরাট করতে হবে।
  • তারপর মাটিতে রস না থাকলে হলকা পানি সেচ দিতে হবে।
  • রোট কাটং পদ্ধতি ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে চারা বপন করা হয়।

বীজ বোনার ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ লাগতে পারে অঙ্কুরিত হতে। চারা গাজানো পর আঙ্গুরের শাখা-প্রশাখা ছড়ানোর জন্য গাছের গোড়ায় শক্ত কাঠি দিতে হবে এবং মাচার ব্যবস্থা করতে হবে।

আঙ্গুর ক্ষেতে যেভাবে সার প্রয়োগ করবেন

চারা বা বীজ বপনের ১০-১৫ দিন আগে প্রতি গর্তে ৪০ কেজি গোবর, ৪০০ গ্রাম পটাশ, ৫০০ গ্রাম ফসফেট এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মাটির সাথে মিশাতে হবে; যেন সারগুলো ভালোভাবে মাটির সাথে মিশে যায়।

  • এর পর ১ মাসের মধ্যে ৫ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করতে পারেন; গাছ বৃদ্ধির জন্য।
  • চারা বা বীজ বপনের ১ থেকে ৩ বছর পর্যন্ত প্রতিটি গাছে বছরে ১০ কেজি গোবর, পটাশ ৪০০ গ্রাম , ফসফেট ৫০০ গ্রাম এবং ১০০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।

আঙ্গুর ক্ষেতে পটাশ সারের ব্যবহারে ফল মিষ্টি হয় এবং রোগবালাইয়ের উপদ্রব কম দেখা দেয়। আঙ্গুর লতানো গাছ তাই গাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য বাড়তি সার প্রয়োগ করতে পারেন।

এছাড়া ভালো ফলনের জন্য বয়স্ক আঙ্গুর গাছের জন্য প্রতি বছরের এপ্রিলের দিকে ২ কেজি তেলের খৈল, ১ কেজি হাড় চূর্ণ এবং ২৫০ গ্রাম সালফেট অব পটাশ ব্যবহার করতে পারেন।

রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন

সাধারণত আঙ্গুর ক্ষেতে পিঁপড়া ও বিভিন্ন ধরণের পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়ে থাকে। এসব পিঁপড়া ও পোকামাকড়ের আক্রামণ থেকে এই ফলের গাছকে বাঁচাতে নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে।

  • রোগাবালাই প্রতিরোধে প্রতি সাপ্তাহে ১ বার এম ৪৫ বা সাফ বা ব্লাইটক্স ১ লিটার পানিতে ১ চামচ দিয়ে স্প্রে করতে পারেন।
  • এছাড়া পোকার মধ্যে মিলিবাগের জন্য ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো) প্রয়োগ করতে পারেন।
  • থ্রিপস এর জন্য ডাইমথয়েড কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
  • আর মাইটস/মাকড় এর জন্য ভার্মিটেক/ওমাইট/থিয়াভিট স্প্রে করতে হবে।
গাছের কান্ড ছাঁটাই এবং পরিচর্যা করবেন যেভাবে

আঙ্গুরের বীজ বা চারা বপনের পরবর্তী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মাচায় ছড়িয়ে থাকা আঙ্গুর গাছের কান্ড ছেঁটে দেওয়া উত্তম।

এতে এই ফল গাছের ফলন বৃদ্ধি পাবে এবং ফুল ঝরে পড়াও অনেক কমে যায়। ছাঁটাই এর ৭ দিন আগে এবং পরে গাছের গোড়ায় হালকা পানি সেচ দিতে হবে।

চারা বপনের পর মাচায় ওঠা পর্যন্ত প্রধান কাণ্ড ছাড়া অন্য সকল পার্শ্বের শাখা ছাঁটাই করে দিতে হবে।

  • প্রথম ছাঁটাই: মাচায় ৩৫ থেকে ৪৫ সে.মি. কান্ড ওঠার পর প্রধান কান্ডের শীর্ষদেশ কেটে দিতে হয় যাতে এই কান্ডের ২ দিক থেকে ২-৪ টি করে শাখা গজায়।
  • দ্বিতীয় ছাঁটাই: গজানো শাখাগুলো বড় হয়ে ১৫ থেকে ২০ দিনের মাথায় ৪৫-৬০ সে.মি. লম্বা হবে তখন এগুলো শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে; এতে অনেক গুলো শাখা-পাশাখা গজাবে।
  • তৃতীয় ছাঁটাই: এই শাখা-পাশাখা গুলো ১৫ থেকে ২০ দিনের মাথায় ৪৫-৬০ সে.মি. লম্বা হবে তখন আবার এদের শীর্ষদেশ কেটে দিতে হবে।

প্রথম বছর ফল সংগ্রহের পর ফেব্রুয়ারী মাসের দিকে শাখাগুলোকে ১৫ থেকে ২০ সে.মি. লম্বা রেখে ছেঁটে দিতে হবে ফলে বসন্তের পক্কালে নতুন নতুন শাখা গজাবে এবং ফুল ধরবে। এই পদ্ধতি ৩ থেকে ৪ বছর পর্যন্ত আঙ্গুরের ফলন সংগ্রহ করা যাবে।

আঙ্গুর পাখি খেয়ে ফেলে তাই সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া এই ফল পাকার সময় বৃষ্টি হলে ফলের গুণাগুণসহ আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়।

তাছাড়া বৃষ্টির পানি লাগলে আঙ্গুর ফেটে যাবার সম্ভাবনা থাকে; তাই বৃষ্টিরা সম্ভাবনা থাকলে পলিথিন জাতীয় কাগজ দিয়ে গাছ ঢেকে দিতে পারেন।

কিভাবে টবে আঙ্গুর চাষ করবেন জেনে নিন

দিন দিন বাড়ির আঙিনা বা ছাদ বাগানে টবে বিভিন্ন ধরনের ফল-ফুল জন্মানো সাধারণ মানুষের জন্য সহজ হয়ে উঠেছে। এর ফলে বাড়িতে সতেজতা দেওয়ার পাশপাশি নিজস্ব খারার বাড়ানোর সাথে অর্থ বাঁচানোর উপায় খুঁজে পেয়েছে মানুষ।

ইচ্ছে করলেই আপনিও বাড়ির আঙিনা বা ছাদ বাগানে টবে খুব সহজে আঙ্গুরের চাষ করতে পারেন। এবার জেনে নিন কিভাবে টবে আঙ্গুর চাষ কররেন।

  • টবে আঙ্গুর চাষের জন্য কমপক্ষে ১২ ইঞ্চির টব বা ড্রাম সংগ্রহ করতে হবে।
  • তারপর টব বা ড্রামে মাটি তৈরির ক্ষেত্রে ২ ভাগ নদীর বলি মাটি, ২ ভাগ জৈবসার, ১ ভাগ মাটি ও ১ ভাগ কোকোপেট বা গাছের গুড়া বা ধানের তুষ দিতে পারেন।
  • এরপর টবে আঙ্গুরের চারা বা বীজ লাগিয়র হালকা পানি সেচ দিতে হবে।
  • টব বা ড্রামে আঙ্গুর চাষের ক্ষেতে গাছ অবশ্যই রোদে রাখতে হবে এবং নিয়মিত পানি দিতে হবে।
  • তবে গাছের গোড়ায় কোন ভাবে পানি না জমে সেক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • আবার টবের মাটি শুঁকিয়ে যায় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
  • টবে সার প্রয়োগ করার নিয়ম হল – ১২ ইঞ্চি টবের জন্য আড়াই চামচ পটাশ, ২ চামচ ইউরিয়া, ২ চামচ ফসফেট একসাথে মিশিয়ে এর থেকে আড়াই চামচ নিয়ে প্রত্যেক ২০ দিন পর পর প্রয়োগ করতে হবে।
  • এছাড়া ১ মুটো সরিষার খৈল, ২ চামচ হাড় গুড়ো এবং ১ চামচ পটাশ একসাথে মিশিয়ে প্রতি মাসে একবার করে প্রয়োগ করতে পারেন।
ফলন ও ফল সংগ্রহ

মূলত আঙ্গুর ফল পরিপক্কভাবে পাকলে তখনই ফল সংগ্রহ করতে হয়। তবে এপ্রিল থেকে মে মাসে আঙ্গুরের গাছে ফুল দেখা দেয় এবং আগস্ট থেকে ফল পাকা শুরু করে।

গ্রীষ্মকালে সাধারণত আঙুর ফল সংগ্রহ করতে হয়; কারণ এই ফল পাকতে পাকতে বর্ষাকাল চলে আসলে ফলের মিষ্টি কমে যায়।

তবে আবার আঙ্গুর পুরোপুরি পেকে যাবার পরেও সংগ্রহ না করা হলে পরে তার মিষ্টতা নষ্ট হতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে পচন ধরতে আরম্ভ করে।

পরিমিত সার এবং উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে একটি আঙ্গুর গাছ না হলেও ৩-৮ বছর ফলন দিতে পারে।

একটি হিসাবে দেখা গেছে আমাদের দেশে ৯ বর্গমিটার জায়গায় ৪-৫টি আঙ্গুর গাছ লাগিয়ে বছরে সর্বোচ্চ ১৬ কেজির মত আঙ্গুরের উৎপাদন সম্ভব।

বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *