মসলা জাতীয় ফসল ধনিয়ার পাতা দৈনন্দিন খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে তোলার পাশাপাশি বিভিন্ন মুখরোচক খাবারে সঙ্গে যুক্ত ধনিয়া বীজ।
আমাদের দেশে শীতকালীন নতুন সবজির মতো ধনিয়া পাতার চাহিদাও থাকে শীত জুড়ে।
কিন্তু, বর্তমানে ধনিয়ার বারোমাসি কিছু জাতের কল্যাণে বর্ষা ছাড়া সারাবছরই ধনিয়া পাতা সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। ধনিয়া সাধারণত শীতকালীন বা রবি ফসল হলেও, এখন দেশে সারাবছর ধনিয়া পাতার চাষ করা যায়।
তাপ সহনশীল বলে বছরের যেকোনও সময় চাষ করা সম্ভব। তাই আজ আমরা ধনিয়া চাষ এর সহজ পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।
সঠিক ধনিয়া চাষ পদ্ধতি
সুনিষ্কাশিত বেলে দো-আঁশ থেকে এটেল দো-আঁশ মাটি ধনিয়া চাষের জন্য উপযুক্ত হলেও প্রায় সব ধরনের মাটিতে ধনিয়া চাষ করা যায়।
এছাড়াও টবে বা ছাদেও চাষ করা যায়। তবে মাটির পিএইচ পরিসীমা ৮-১০ হওয়া উচিত।
ধনিয়া চাষের জন্য পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক ।
মাটি ভেদে ৪-৬ বার চাষ ও মই দিয়ে জমি ভালভাবে প্রস্তুত করে, শেষ বার চাষের আগে জমিতে গোবর সার ৪০ কুইন্টাল ( একর প্রতি) প্রয়োগ করুন।
পাতা জন্য সারাবছর ধনিয়া চাষ করা যায়, কিন্তু বীজের ক্ষেত্রে শুষ্ক ও ঠাণ্ডা আবহাওয়ার প্রয়োজন।
এইজন্য বীজের ক্ষেত্রে শীতকাল বা রবি মরশুমে চাষ করা হয়।
ধনিয়া বীজের ক্ষেত্রে গাছে ফুল আসার সময় মেঘলা আকাশ, বৃষ্টিপাত বা কুয়াশা হলে রোগপোকার আক্রমণ হয় এবং বীজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়।
ধনিয়ার বীজ বপন
ধনিয়ার বীজ রোপণের জন্য পোড়া পদ্ধতি ব্যবহার করুন।
ধনিয়া পাতার জন্য সেপ্টেম্বর-মার্চ মাসে এবং বীজের জন্য অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বপন করা হয়।
জমি তৈরির পর লাইন করে অথবা ছিটিয়ে বীজ বোনে, হালকা করে মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তারপর হালকা সেচ দিতে হবে। সাধারনত ৭-১০ দিনের মধ্যে চারা বের হয়।
তবে বর্তমানে ধনিয়ার বারোমাসি জাত আছে,যা সারা বছর বপন করা সম্ভব।
- বীজ বপনের আগে পানিতে ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে।
- বীজ ছিটিয়ে বপন করলে হেক্টরপ্রতি ৮ কেজি বীজ ব্যবহার করতে হয়।
- মিশ্র ফসল হিসেবে সার পদ্ধতিতে বপনের জন্য ৪-৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
বীজ শোধন
দ্রুত অঙ্কুর হওয়ানোর জন্যে বীজ বুনার আগে, বীজ পানিতে ১০-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন।
শিকড় পচা রোগ থেকে রক্ষা পেতে বপনের আগে ধনিয়া বীজে ভালো কোনও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করুন।
বিনা চাষে ধনিয়া চাষ
অনেকই রবি মৌসুমে ধান কেটার পর চাষ না দিয়ে সেই জমিতে বীজ ছিটিয়ে দেওয়া, এতে কম খরচে ভালো উৎপাদন পাওয়া যায়।
সার ও প্রয়োগ
ধনিয়ার ভালো ফলন পেতে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করতে হবে। তবে, জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার ব্যবহার করলে মাটির গুণাগুণ ও পরিবেশ উভয়ই ভালো থাকবে।
ধনিয়া চাষের জন্য ( হেক্টরপ্রতি)
- গোবর ৮-১০ টন,
- ইউরিয়া ২৮০-৩১০ কেজি,
- টিএসপি ১১০-১৩০ কেজি,
- এমপি ৯০-১১০ কেজি ,
- জিপসাম ৬০-৭৫ কেজি,
- জিংক সালফেট ১২-১৫ কেজি সার প্রয়োগ করতে হয়।
জমি তৈরির সময় অর্ধেক গোবর, সব টিএসপি ও অর্ধেক এমপি সার প্রয়োগ করতে হয়।
বাকি অর্ধেক গোবর চারা রোপনের এক সপ্তাহ আগে মাদায় দিয়ে মিশিয়ে রাখতে হবে। এরপর চারা রোপন করে সেচ দিতে হবে।
ইউরিয়া এবং বাকি অর্ধেক এমপি সার ২ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে।
চারা লাগানোর ৮-১০ দিন পর ১ম কিস্তি এবং চারা লাগানোর ৩০-৫০ দিন পর বাকি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
পরিচর্যা ও সেচ
আগাছা ধনিয়া গাছ বৃদ্ধিতে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে।
- ধনিয়া ক্ষেত আগাছা মুক্ত রাখতে এক বা দুইবার আগাছা পরিষ্কার করুন।
- বীজ বপনের পর প্রথমবার ৪ সপ্তাহ এবং দ্বিতীয়বার ৫-৬ সপ্তাহ পর আগাছা পরিষ্কার করুন।
এছাড়া মাটিতে উপস্থিত আর্দ্রতা অনুযায়ী সেচ দিতে হবে।
বীজ বপনের পরপরই প্রথম সেচ দিতে হবে। পরবর্তী সেচগুলি ১০ থেকে ১২ দিনের ব্যবধানে দিতে হবে।
চারা গজানোর ১০-১৫ দিন পর সারিতে ৫ সেন্টিমিটার পর পর একটি চারা রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হয়। বীজ ফসলের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ সেন্টিমিটার পর পর একটি চারা রাখতে হয়।
ধনিয়ার রোগবালাই ও তার প্রতিকার
ধনিয়া চাষে পোকার আক্রমণ হলে জৈব কীটনাশক ব্যবহার করা। এছাড়া…
পাতার দাগ রোগ
এই ছত্রাকজনিত রোগ জীবাণু বাতাস দ্বারা ধনিয়া পাতাতে ছড়ায়। প্রথমে পাতায় হলুদ রংয়ের দাগ পড়ে এবং পরে তাসাদা হয়ে যায়। দাগগুলো একত্র হলে সম্পূর্ণ পাতাটি নষ্ট হয় ।
দমন ব্যবস্থাপনা
- ক্ষেত পরিষ্কার/পরিচ্ছন্ন রাখা।
- রোগাক্রান্ত পাতা তুলে নষ্ট করা।
- ধনিয়ার পাতা ব্যবহার করলে ছত্রাকনাশক ব্যবহার না করে দ্রুত চারা তুলে ফেলুন।
- আক্রমণ বেশি দেখা দিলে রোভরাল ২ গ্রাম বা ডাইথেন এ্ম ৪৫ ছত্রাকনাশক ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা ।
- স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে ধনিয়া খাবেন না বা বিক্রি করবেন না।
ধনিয়ার পাতা সবজি বা মসলা হিসাবে ব্যবহার করলে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করবেন না।
শিকড় পচা
ধনিয়ার মূল পচা থেকে রক্ষা করতে প্রতিরোধের ব্যবস্থা হিসাবে নিমের কেক ৬০ গ্রাম/ একর জমিতে ব্যবহার করুন।
এছাড়াও বীজ বোনার আগে ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি ৪ গ্রাম / কেজি বীজের সাথে বীজ শোধন করুন।
শিকড় পচা রোগের আক্রমণ থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে, Carbendazim ৫ গ্রাম/লিটার পানিতে অথবা কপার অক্সি ক্লোরাইড ২ গ্রাম / লিটার পানিতে মিশিয়ে মাটিতে ঢালুন।
টবে ধনিয়া পাতা চাষের পদ্ধতি
প্রায় বারমাসি সবজি ধনিয়া, প্রচুর আলো বাতাস পায় এমন স্থান বেছে নিয়ে বাসার বারান্দায় বা ছাদে চাষ করা যায়।
- চাষের জন্য টব বা প্লাস্টিক অথবা কাঠের কনটেইনারও ব্যবহার করা সম্ভব।
- প্লাস্টিকের বালতিতেও করতে পারেন।
- মাঝারি সাইজের একটি টব বেছে নিন।
- মাঝারি আকৃতির টবে ১০০টি গাছের চাষ করা সম্ভব।
মাটি ও বীজ প্রস্তুত
ধনিয়া পাতা চাষের জন্য সাধারণত বেলে দোআঁশ মাটি ও এটেল মাটি ভাল, সব ধরণের মাটিতে চাষ করা যায়।
ধনিয়া পাতা বীজ লাগানোর পূর্বে ১০-১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে তাড়াতাড়ি গজাবে।
বীজ রোপণ ও যত্ন
ধনিয়া পাতা গাছ লাগানোর পর মাটিতে আদ্রতা না থাকলে ২/১ দিন পর পর পানি দিতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে ধনিয়া গাছ কখনই জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।
- ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার গভীরে ধনিয়ার বীজ বপন করতে হবে।
- বীজ বপন করা হলে আবার মাটি দিয়ে ঢেকে পানি দিতে হবে।
- কিন্তু মাটি ভেজা থাকলে পানি দেওয়ার দরকার নেই।
- জমাকৃত অতিরিক্ত পানি বা বৃষ্টির পানি ২-১ ঘণ্টা মধ্যেই নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে ধনিয়া পাতা গাছ পচে যাবে এবং নষ্ট হয়ে যাবে।
এছাড়া পাখি যাতে পাতা না খায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় বীজ বোনার পর পিঁপড়া বীজ খেয়ে ফেলে। তাই খেয়াল রাখতে হবে যাতে পিপড়া বীজ না খেয়ে ফেল।
ফসল তোলা
ধনিয়া বীজ বুনার ৩০ থেকে ৩৫ দিন পর পাতা সংগ্রহ শুরু করে মাসখানেক ধরে এ সংগ্রহ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।
শেষ কথা
ধনিয়া পাতা চাষের ক্ষেত্রে গাছের অনেক যত্ন নিতে হয়। ধনিয়া পাতা গাছের সাথে অনেক আগাছা ও পরগাছা জন্ম নেয়। তাই সর্বদা আগাছা পরিষ্কার করতে হবে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হবে।
সুত্র: লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
আরো পড়ুন …
- আধুনিক বেগুন চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা
- বরবটি চাষ পদ্ধতি ( বারোমাসই চাষ করুন )
- অধিক ফলন পেতে যেভাবে মিষ্টি কুমড়া চাষ করবেন
- লাউ চাষের সহজ পদ্ধতি ও পরিচর্যার সঠিক নিয়ম
- জেনে নিন পটল চাষের সঠিক পদ্ধতি ও পরামর্শ
- কোন মাসে কী ধরনের শাক-সবজি ও ফল চাষ করবেন
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।