বরবটি চাষ পদ্ধতি ( বারোমাসই চাষ করুন )

উষ্ণ ও অবউষ্ণ অঞ্চলের বারোমাসি সবজি ‘বরবটি’ প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায়।

অপেক্ষাকৃত খরিপ তথা গ্রীষ্ম মৌসুমে (মার্চ-সেপ্টেম্বর) বরবটির ভালো ফলন হলেও, খুব শীতে তেমন ভালো হয় না।

কারণ শীতকালে বরবটি গাছের বৃদ্ধি ও ফলন কম ধরে। এবার জেনে নিন বরবটি চাষ পদ্ধতি।

বরবটি চাষের সহজ পদ্ধতি

প্রায় সব ধরনের মাটিতে বরবটির চাষাবাদ হলেও দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি উত্তম।

ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই মাসে বরবটির বীজ বোনার উপযুক্ত সময়, শীতকালে বরবটির বীজ বপন করা উচিত নয়।

বরবটি চাষের জন্য মাটিতে উপযুক্ত পরিমাণে জৈব সার এবং সার ব্যবহার করা দরকার।

এছাড়া চাষাবাদের জমিতে পানি নিকাশনের নালা তৈরির পাশাপাশি গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমে না থাকে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

জমি তৈরি ও বীজ বপন

বরবটি চাষের জমি বীজ বোনার আগে ৩-৪ বার চাষ এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।

উচ্চফলনশীল স্পেশাল বরবটি বীজ (হাইব্রিড)
উচ্চফলনশীল স্পেশাল বরবটি বীজ (হাইব্রিড) কিনুন 

এরপর নির্দিষ্ট দূরত্বে গর্ত করতে হবে। তবে ভালো ফলনের জন্য সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায় এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে।

তবে বাণিজ্যিক চাষাবাদের জন্য সারিতে বুনতে হবে।

  • সারি থেকে সারির দূরত্ব ১.৫ মিটার।
  • গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১.৫ ফুট।
  • জাত হিসেবে সারির দূরত্ব ১ মিটার বাড়ানো বা কমানো যায়।

বরবটি চাষের জন্য শতাংশ ১০০-১২৫ গ্রাম, হেক্টর প্রতি ৮-১০ কেজি বীজ প্রয়োজন। তবে বপনের আগে বীজ ভাল ভাবে শোধন করে নিতে হবে; প্রয়োজন মতো সেচ দিতে হবে।

টবেই বরবটি চাষ

দেশে সাধারণত শখের বসে বা পরিবারের সবজির চাহিদা মেটাতে অনেকেই বাসার ছাদের টবে সবজির চাষাবাদ করে থাকে,।

টবে বারোমাসি সবজি বরবটির চাষ করার জন্য ৪০% সাধারণ মাটি, ২০% বালি, ২০% জৈব সার (ভার্মি কম্পোস্ট), ২০% কোকোপিট এর একটি সুনিষ্কাশন (Well Drain) মিশ্রণ তৈরি করে নিতে হবে।

যে টবটি নেবেন তার নিচে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক রাখার জন্য টবটির নিচে কয়েকটি নুড়ি রাখতে হবে।

তার উপরের স্তরে কিছুটা বালি দিতে হবে। এরপর মাটির মিশ্রণটি দিয়ে টব ভরাট করতে হবে।

সার প্রয়োগ

বরবটির ভালো ফলন পাওয়া জন্য মাটির উর্বরতার উপর নির্ভর করে জমিতে সার প্রয়োগ করা দরকার।

তবে মাটির গুণগতমান পরীক্ষা করে পরিবেশ এবং মাটির স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সব সময় জৈব সার ব্যবহার করা উচিত ।

এছাড়া টিএসপি সম্পূর্ণ পরিমাণ ও অর্ধেক এমওপি সার শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হয়। সারের পরিমাণ ( প্রতি শতকে)…

  • ইউরিয়া – ১০০ গ্রাম
  • টি এস পি-  ৯০ গ্রাম
  • এমওপি- ৭৫ গ্রাম
  • গোবর-  ২০ কেজি

বীজ বপনের পর ২০ দিন পর ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও বাকি অর্ধেক এমওপি সার জমিতে উপরি প্রয়োগ করতে হয়।

উল্লেখ্য বাড়ির আঙিনায় বরবটি চাষ করতে চাইলে প্রতিটি গর্তে ৩-৫ কেজি পচা ঝুরঝুরে গোবর সার, ৭৫ গ্রাম এসএসপি, ১০০ গ্রাম নিমখোল দিয়ে ভাল ভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হবে।

এই জাতীয় সবজিতে নাইট্রোজেনঘটিত সার কম প্রয়োগ করতে হয় যদি অণুখাদ্যের অভাব হয়, তা হলে প্রয়োজন মতো অণুখাদ্যের মিশ্রণ ২ গ্রাম প্রতি লিটার হিসাবে পানিতে গুলে পাতায় স্প্রে করতে হবে।

পরিচর্যা

বরবটি গাছ বড় হলে মাচা বা বাউনি দেওয়ার পাশাপাশি গাছের চারপাশ আগাছমুক্ত রাখতে হবে।

এছাড়া প্রয়োজন অনুসারে সবসময় সেচ দিতে হবে।

অপরদিকে সেচ বা বৃষ্টির পানি যাতে বেশি দিন গাছের গোড়ায় জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

পোকামাকড় ও রোগ দমন

বরবটি বীজ
কেগরনাটকি জাতের বরবটি বীজ কিনুন 

বরবটির পোকামাকড় ও রোগ দমন ও ব্যবস্থাপনা অন্য সব সবজির মতোই। তবে জাব পোকা, ফল ছিদ্রকারী পোকা ও মোজেইক রোগ বরবটি চাষের অন্যতম সমস্যা।

এসব রোগ বা পোকাগুলো দমনের জন্য বিভিন্ন ধরণের উন্নত মানের কীটনাশক বা বলাইনাশক পাওয়া যাচ্ছে বাজারে।

মোজাইক রোগের আক্রমণ

ফসলের বাড়ন্ত বা চারা পর্যায়ে ভাইরাসের আক্রমণে এই রোগ হয়ে থাকে।  কাণ্ড ,পাতা, গাছে হলুদ ও গাঢ় সবুজ ছোপ ছোপ মোজাইক করা পাতা দেখা দেয়।

এই রোগ দমনে ক্ষেত থেকে আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলার পাশাপাশি ডালা কেটে দেওয়া উত্তম।

জাব পোকা মোজাইক রোগের বাহক, এ পোকা দমনে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক ১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করুন।

পাতার দাগ রোগ

বরবটি গাছে ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। এ রোগে পাতায় বৈশিষ্টপূর্ণ দাগ (বাদামি বা সাদাটে এবং কিনারা কালচে ও হলুদ) দেখা যায়।

আক্রান্ত গাছের পাতা ও ডগা অপসারণ করে মাটিতে পুতে বা পুড়ে ফেলা এই রোগ দমনের কার্যকর পন্থা ।

আক্রমণ বেশি হলে কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাক নাশক ১ গ্রাম / লি. হারে পানিতে মিশিয়ে শেষ বিকেলে স্প্রে করা।

নেতিয়ে পড়া রোগ

এই রোগের লক্ষণ কচি পাতা হঠাৎ করে নেতিয়ে পড়ে, পরবর্তীতে গাছ মারা যায়।

সাধারণত বীজ বোনার পূর্বে বীজ শোধন করলে এই রোগ হওয়ার সম্ভবনা কম থাকে।

ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ

এই পোকা ফল ও বীজ ছিদ্র করে নষ্ট করে ।

এই পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচতে জৈব বালাইনাশক পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করা।

জাবপোকা বা এফিড

জাব পোকা গাছের কচি পাতা ও ডগার রস শুষে খেয়ে গাছকে দুর্বল করে ফেলে। পিপিলিকার উপস্থিতি এ পোকার উপস্থিতিকে অনেক ক্ষেত্রে জানান দেয়।

এর আক্রমন বেশি হলে শুটি মোল্ড ছত্রাকের আক্রমন ঘটে এবং গাছ মরে যায়। পরভোজী বন্ধু পোকা যেমন লেডি বার্ড বিটল লালন করা।

প্রাথমিক পর্যায়ে ডিটারজেন্ট (৪ গ্রাম/লিটার) পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা। আর আক্রমণ বেশি হলে এডমেয়ার ০.৫ মি.লি./লি. হারে পানিতে মিশিয়ে শেষ বিকেলে স্প্রে করা।

থ্রিপস পোকার আক্রমণ

উচ্চফলনশীল লাল বরবটি বীজ (হাইব্রিড)
উচ্চফলনশীল লাল বরবটি বীজ (হাইব্রিড) কিনুন 

এই পোকার আক্রমণে ফুল ও কচি ফল দাগ হয় । এছাড়া গাছের কচি পাতা ও ডগার রস শুষে খেয়ে গাছকে দুর্বল করে ফেলে।

হলুদ রঙের ফাঁদ ব্যবহার করা যেতে পারে। আক্রমণ বেশি হলে এডমেয়ার ২০ এসএল ০.৫ মিলি./লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করা।

পাতা মোড়ানো পোকার আক্রমণ

কীড়া অবস্থায় পাতা মোড়ায় এবং সবুজ অংশ খায়। এটি সাধারণত কচি পাতাগুলোতে আক্রমণ করে থাকে ।

আক্রমণ বেশি হলে প্রতি লিটার পানিতে সুমিথিয়ন বা ফলিথিয়ন-২ মিঃলিঃ মিশিয়ে ভালভাবে স্প্রে করা ।

মরিচা রোগ

ছত্রাকের আক্রমনে এ রোগ (পাতায় ও ফলে মরিচারমত দাগ) হয়।

প্রপিকোনাজলগ্রুপের ছত্রাকনাশক পানিতে মিশিয়ে ১০ দিন পরপর ৩ বার শেষ বিকেলে স্প্রে করা।

ক্ষুদ্র লাল মাকড়ার আক্রমণ

ক্ষুদ্র মাকড়ার আক্রমণ স্থান প্রথমে বিন্দু বিন্দু হলুদ ও পরে সাদা হওয়ার পাশাপাশি গাছের বৃদ্ধি কমে যায় ।

এছাড়া পাতার উল্টো দিকে বসে রস চুসে খাওয়ায় পাতার আকৃতি নষ্ট হয়ে যায় ।

মাকড়া দমনে সালফার গ্রুপের মাকড়নাশক ৪ গ্রাম বা মি.লি. / লি. হারে পানিতে মিশিয়ে পাতার নিচের পিঠ সহ স্প্রে করতে হবে।

ফসল সংগ্রহ

বরবটি বীজ বপনের ৫০- ৬০ দিন পর ফসল আসে। কচি বরবটি সংগ্রহ করতে হয়, বেশি পুষ্ট হলে সব্জি হিসাবে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যায়। শতক প্রতি বরবটি ফলন ৩০-৬০ কেজি এবং হেক্টর প্রতি ১০-১২ টন হয়ে থাকে।

শেষ কথা

মনে রাখবেন বরবটির চাষাবাদে ইউরিয়া সার ব্যবহার কম করতে হয়। ইউরিয়া সার বেশি দিলে গাছ ঝোপালো হয় ও ফলন কম হয়। তবে ভালো ফলনের জন্য গোবর সার, জিপসাম সার, জিংক সালফেট সার ও বোরক্স সার দিতে পারেন।

সুত্র: লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?