তিল চাষের আধুনিক পদ্ধতি: কম খরচে বেশি লাভ

তিল আমাদের দেশের খুবই জনপ্রিয় একটি তেলবীজ। অনেকেই জানি না যে, খাবারের তেল হিসাবে সরিষার তেলের থেকেও তিলের তেল স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। এর ইংরেজি নাম Sesame এবং বৈজ্ঞানিক নাম Sesamum indicum। অন্যান্য ফসলের তুলনায় তিল চাষ খুবই সহজ এবং খরচও অনেক কম। যেকোনো সাধারণ বা পতিত জমিতেও এর চাষ করা যায়।

আসুন, তিল চাষের আধুনিক পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

অধিক ফলনের জন্য উন্নত জাত

বর্তমানে বাংলাদেশে তিলের অনেক উন্নত ও উচ্চ ফলনশীল জাত পাওয়া যায়। অধিক ফলনের জন্য নিচের জাতগুলো খুবই উপযোগী: বিনা তিল-৩,  বিনা তিল-৪, বারি তিল-৩ এবং  বারি তিল-৪।

জমি ও মাটি নির্বাচন

বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি তিল চাষের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। তবে, জমিতে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকলে অন্যান্য মাটিতেও তিল চাষ করা যেতে পারে।

জমি তৈরির জন্য জমির প্রকারভেদে ৩-৪টি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ভালোভাবে ঝুরঝুরে করে প্রস্তুত করতে হবে।

বীজ বপনের উপযুক্ত সময়

তিল খরিফ ও রবি—উভয় মৌসুমেই চাষ করা যায়।

  • খরিফ-১ মৌসুম: ফাল্গুন-চৈত্র মাস (মধ্য-ফেব্রুয়ারি হতে মধ্য-এপ্রিল)।
  • খরিফ-২ মৌসুম: ভাদ্র মাস (মধ্য-আগস্ট হতে মধ্য-সেপ্টেম্বর)।
  • রবি মৌসুম: কার্তিক-ফাল্গুন (১৬ অক্টোবর থেকে ১৫ মার্চ)।

কৃষি বিষয়ক নিউজলেটার’
AgriNext Weekly হলো বাংলাদেশের প্রথম সমন্বিত কৃষি নিউজলেটার, যেখানে প্রতি বৃহস্পতিবার আপনি পাবেন কৃষি, চাষাবাদ, কৃষি-প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক কৃষি-অর্থনীতির সর্বশেষ খবর, বিশ্লেষণ ও দিকনির্দেশনা—এক নজরে, এক ইমেইলে।

📩 এখনই সাবস্ক্রাইব করুন​ →

 বীজের হার ও বপন পদ্ধতি

বীজ বপনের দুটি প্রধান পদ্ধতি রয়েছে এবং সে অনুযায়ী বীজের হারে তারতম্য হয়:

  • ছিটিয়ে বপন: হেক্টর প্রতি ৭.৫ থেকে ৮.০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
  • সারিতে বপন: হেক্টর প্রতি ৬.০ থেকে ৭.০ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়।

সারিতে বপন করলে ফলন ভালো হয়। এক্ষেত্রে, সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ইঞ্চি এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ১.৫ থেকে ২.০ ইঞ্চি রাখতে হবে।

 সার ব্যবস্থাপনা (প্রতি একরে)

সুষম সার প্রয়োগে তিলের ফলন বহুগুণ বাড়ে। প্রতি একর জমির জন্য সারের পরিমাণ নিচে দেওয়া হলো:

সারের নাম পরিমাণ (প্রতি একরে) প্রয়োগ পদ্ধতি
ইউরিয়া ৪০-৫০ কেজি অর্ধেক শেষ চাষের সময়, বাকি অর্ধেক ২৫-৩০ দিন পর উপরি প্রয়োগ
টিএসপি ৫২-৬০ কেজি সম্পূর্ণ অংশ শেষ চাষের সময়
এমওপি (পটাশ) ১৬-২০ কেজি সম্পূর্ণ অংশ শেষ চাষের সময়
জিপসাম ৪০-৪৫ কেজি সম্পূর্ণ অংশ শেষ চাষের সময়
জিংক সালফেট ৪ কেজি (ঘাটতি থাকলে) শেষ চাষের সময়
বরিক এসিড ৩ কেজি (ঘাটতি থাকলে) শেষ চাষের সময়

প্রয়োগ কৌশল: জমি প্রস্তুতের শেষ চাষের সময় অর্ধেক ইউরিয়া এবং বাকি সব সার (টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক, বোরন) মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর (গাছে ফুল আসার সময়) উপরি প্রয়োগ করতে হবে।

 সেচ ও নিকাশ ব্যবস্থাপনা

তিল ফসল খরা সহনশীল হলেও ভালো ফলনের জন্য সেচ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি।

  • বীজ গজানোর সেচ: খরিপ-১ মৌসুমে (ফাল্গুন-চৈত্র) মাটিতে প্রায়ই রসের অভাব থাকে। এমন পরিস্থিতিতে বীজ বপনের পূর্বে জমিতে অবশ্যই একটি সেচ দিয়ে নিতে হবে। মাটিতে ‘জো’ (আর্দ্রতা) আসার পর চাষ দিয়ে বীজ বপন করতে হবে।
  • ফুল আসার সময় সেচ: বীজ বোনার ২৫-৩০ দিন পর ফুল আসার সময় জমিতে রসের অভাব হলে অবশ্যই একটি সেচ দিতে হবে।
  • ফল ধরার সময় সেচ: ৫৫-৬০ দিন পর ফল ধরার সময় জমিতে রসের অভাব হলে আরও একটি সেচ দিতে হবে।

বিশেষ সতর্কতা: তিল ফসল দীর্ঘ জলাবদ্ধতা বা গোড়ায় পানি জমা একদমই সহ্য করতে পারে না। বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের জন্য জমির মধ্যে মাঝে মাঝে নালা কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। জলাবদ্ধতার কারণে দ্রুত গোড়া পঁচা রোগ হয়ে তিলগাছ মরে যায়।

আগাছা দমন ও পরিচর্যা

অধিক ফলন পেতে হলে জমি অবশ্যই আগাছামুক্ত রাখতে হবে। চারা অবস্থায় প্রথম ২০ দিন পর্যন্ত গাছের বৃদ্ধি খুব ধীর গতিতে হয়। এই সময়ে আগাছা দ্রুত বেড়ে তিল গাছ ঢেকে ফেলতে পারে।

তাই বীজ বপনের আগেই জমি ভালোভাবে আগাছামুক্ত করতে হবে এবং প্রয়োজনে চারা গজানোর পর একটি নিড়ানী দিতে হবে।

বালাই ব্যবস্থাপনা

তিল ফসলে কান্ড পঁচা রোগ, বিছা পোকা ও হক মথের আক্রমণ দেখা যায়।

কান্ড পঁচা রোগ:

  • প্রতিকার: এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। বপনের আগেই প্রতি কেজি বীজের সাথে ২-৩ গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ ছত্রাকনাশক মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিলে রোগের আক্রমণ অনেক কমে যায়।
  • দমন: জমিতে রোগ দেখা দিলে বেভিষ্টিন বা ডাইথেন এম-৪৫ (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম) অথবা রোভরাল (প্রতি লিটার পানিতে ১ গ্রাম) হারে মিশিয়ে ৮-১০ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে।

বিছা পোকা:

দমন: এই পোকা পাতার নিচে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার সাথে সাথে ডিমসহ পাতা ছিড়ে কেরোসিন/ডিজেল মিশ্রিত পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলুন। পোকার আক্রমণ বেশি হলে নাইট্রো ৫০৫ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ২ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।

ফসল সংগ্রহ ও ফলন

জাত ভেদে তিল ফসল সংগ্রহ করতে সাধারণত ৮৫ থেকে ৯০ দিন সময় লাগে। গড় ফলন: বাংলাদেশে তিলের জাতীয় গড় ফলন হেক্টরপ্রতি ৫০০-৬০০ কেজি। উন্নত ফলন: উন্নত জাতের ব্যবহার, সঠিক সময়ে সেচ, পানি নিকাশ এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে তিলের ফলন হেক্টরপ্রতি ১২০০ থেকে ১৫০০ কেজি পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব।

আরও পড়ুন-

 


Discover more from বীজ ঘর ডটকম

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

মতামত দিন

Item added to cart.
0 items - 0.00
Need Help?