চাহিদা সম্পন্ন গ্রীষ্মকালীন সবজি পটল চাষের জন্য বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি ভালো। তবে নদীর তীরে পলিযুক্ত মাটিতেও পটলের চাষ করা যায়।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পটলের ভিন্ন ভিন্ন জাত দেখা মিলে। জাতভেদে পটলের ফলন পাওয়া যায় প্রতি হেক্টরে ৩০ থেকে ৩৮ টন ।
এছাড়া, বাজারে পটল সবজির প্রচুর চাহিদা থাকায়, কৃষকরা পটলের চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছে |
আসুন ভালো ফলনের জন্য এবার জেনে নেওয়া যাক পটল চাষের সহজ পদ্ধতি।
পটল চাষের পদ্ধতি
পটল চাষে বেশি তাপমাত্রা ও সূর্যালোকের প্রয়োজন। বাংলাদেশের আবহাওয়া অনুসারে অক্টোবর থেকে নভেম্বর অথবা ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পটলের চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত সময়।
বেড পদ্ধতিতে পটল চাষ করলে ভালো ফলনের পাশাপাশি বর্ষাকালে ক্ষেত নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা পাবে।
জমি ও মাদা তৈরী
পটল বেশ খরা সহিষ্ণু। পানি নিষ্কাশনের সুবিধা আছে এমন উঁচু জমি এবং বেলে দো-আঁশ বা দো-আঁশ মাটি পটলের চাষাবাদের জন্য উপযোগী।
পটলের চাষাবাদের চিন্তা করলে অক্টোবর মাসের আগেই জমি তৈরি করতে হবে। পটল চাষের জমি ভালো করে চাষ ও মই দিয়ে আগাছামুক্ত করে মাটি ঝুরঝুরে ও সমান করে নিতে হবে।
- বেড পদ্ধতিতে পটলের চাষাবাদে সাধারণত বেডের চওড়া ১.০-১.৫ মিটার হয়ে থাকে।
- বেডের মাঝামাঝি ১-১.৫ মিটার বা ২-৩ হাত পর পর মাদায় চারা রোপণ করতে হয়।
- বেড থেকে বেডের মাঝে ৭৫ সেমি. নালা রাখতে হবে।
- মাদা বা পিট তৈরির ক্ষেত্রে, মাদা বা পিটের আকার- দৈর্ঘ্য- ৫০ সেমি. প্রস্থ ৫০ সেমি. গভীরতা ৪০ সেমি. নালা ৭৫ সেমি।
- মাদায় গাছের দূরত্ব ৭ থেকে ১০ সেমি, গভীরতা ৫০ সেমি।
- মোথার সংখ্যা ১০,০০০ হেক্টর প্রতি।
- সঠিক পরাগায়নের জন্য ১০% পুরুষ জাতের গাছ ( ক্ষেতের সব অংশে সমানভাবে) লাগানো উচিত।
চারা তৈরী এবং বপন পদ্ধতি
আমাদের দেশে অক্টোবর – নভেম্বর অথবা ফেব্রুয়ারি – মার্চ মাস পটল চারা বোনার উপযুক্ত সময়। পটল সাধারণত কাণ্ড এবং টিউবারের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে।
তবে শাখা কলমের ক্ষেত্রে পরিপক্ব কাণ্ড ব্যবহার করতে হবে। বপনের আগে পটল চারার শিকড় গজিয়ে নিলে বেশি ভালো হয়।
তা নাহলে মাটিতে আর্দ্রতা কম থাকলে শাখা কলম শুকিয়ে মারা যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে পলিব্যাগে শাখা কলম গজিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। বিশেষ প্রক্রিয়ায় পলিব্যাগে চারা তৈরি করে অবশ্যই আগস্ট মাসে তা জমিতে লাগাতে হবে।
এতে তীব্র শীত পড়ার আগেই গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধি হয়।
পটল গাছের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে কাণ্ড মরে গেলেও শিকড় জীবিত থাকে। ফলে এই শিকড় থেকেই আবার গাছ জন্মে।
ফলে মোট জীবনকাল বেশি হলে আগাম ফলন পাওয়া যায় এবং যার বাজার মূল্য তুলনামূলক অনেক বেশি পাওয়া যায়।
পটল চারা বেডের মাঝামাঝি ১-১.৫ মিটার বা ২-৩ হাত পর পর বপন করতে হয়।
গাছ লাগানোর ৯০ থেকে ৯৫ দিনের মধ্যে (প্রায় তিন মাস) ফলন পাওয়া যায়। পটল চাষের ক্ষেত্রে কয়েক দফায় শাখাকলম লাগানো যায় এবং গাছ থেকে সারা বছর ফলন পাওয়া যায়।
মাচা তৈরী
মাচায় পটল চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায় | গ্রীষ্মকালীন এই সবজি লতানো প্রকৃতির উদ্ভিদ হওয়ায় বাউনী বা মাচা দিলে ফলন বেশি হওয়ার পাশাপাশি রোগবালাইয়ের আক্রমণ অনেক কম হয়।
অন্যদিকে মাটির ওপর কিংবা খড় বিছিয়ে পটল উৎপাদন করলে সাদা ফ্যাকাসে বা হলুদ বর্ণ ধারণ করায় এর বাজার মূল্য কমে যায়।
মাটিতে খড়-কুটা বা কচুরিপানার উপর পটলের চাষাবাদ করলে মাটির সংস্পর্শে এসে পটল রোগাক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি ফুল ও ফল নষ্ট হয় এবং আগাছার আক্রমণ বেশি হয়ে থাকে।
৪টি মাদায় একটি করে মাচা দিলে ফসলের পরিচর্যা ও পটল সংগ্রহে অনেক সুবিধা হয়।
সার প্রয়োগ (শতাংশ প্রতি)
পটল দীর্ঘমেয়াদি সবজি ফসল। পটল গাছের বৃদ্ধি ও ভালো ফলন পেতে গোবর বা জৈব সার পরিমাণমত প্রয়োগ করতে হবে।
ফসল সংগ্রহের পর প্রতি মাসে হেক্টরপ্রতি ১৮ কেজি ইউরিয়া, ২৫ কেজি টিএসপি এবং ১৪ কেজি এমপি সার উপরি প্রয়োগে ফলন বেশি হবে।
মাদাপ্রতি ১.০ কেজি গোবর সার, ২৫০ গ্রাম খৈল, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১৭০ গ্রাম টিএসপি, ১৩০ গ্রাম এমওপি, ২০ গ্রাম বোরণ সার এবং ১৫০ গ্রাম জিপসাম সার পটল চারা বপনের সময় প্রয়োগ করে হয়।
এচাড়া ফুল ধরা কমে গেলে মাদা প্রতি ৫০০ গ্রাম গোবর সার, ৭০ গ্রাম ইউরিয়া, ৯০ গ্রাম টিএসপি, ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রয়োগ করলে ফলন অনেক বেড়ে যায়।
সেচ ও পানি নিকাশ
পানির ঘাটতি দীর্ঘায়িত হলে পটলের ফলন কমে যায়। তাই ভালো ফলন পেতে নিয়মিত সেচ দিতে হবে।
পটল গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য না পারায়; বৃষ্টি বা সেচের অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগবালাই ও দমন
পটল গাছ ও ফলের অন্যতম শত্রু ফলের মাছি পোকা, কাটলে পোকা, উঁই পোকা, মিলিবাগ, সাদা মাছি ও লাল মাকড় ।
এসব ক্ষতিকারক পোকা-মাকড়ের আক্রমণ থেকে পটলকে রক্ষা করতে নিয়মিত পরিমাণমত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে ।
মাছি পোকা আক্রমণ
ফলের মাছি পোকা কচি পটলের ভেতর ছিদ্র করে ও ডিম পাড়ে।
এর ফলে ডিম ফুটে বাচ্চা হাওয়ার ফলের নরম অংশ খেয়ে পূর্ণ বয়স্ক পোকা বের হয়ে আসে।
মাছি পোকা আক্রমণ থেকে পটলকে রক্ষা করতে ক্ষেত পরিষ্কার রাখার পাশাপাশি পোকা দমনে ফাঁদের ব্যবহারও ব্যাপক জনপ্রিয়।
বিষটোপ আরেকটি জরুরি দমন উপাদান।
এছাড়া ফেরোমেন ফাঁদ ব্যবহার করে এই পোকা দমন করা সম্ভব।
আক্রমণ মারাত্মক হলে সবিক্রন ২ মিলি/লিটার বা সাইপারমিথ্রিন ১ মিলি/লিটার বা এসিমিক্স ১ মিলি/লিটার জলে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর ৩-৪ বার স্প্রে করেও ভালো ফল পাওয়া যায়।
লাল মাকড় আক্রমণ
আক্রান্ত পাতা শক্ত চামড়ার মতো হয় এবং পাতা বিবর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়।
লাল মাকড় আকারে অত্যন্ত ছোট হয়। এরা পাতার নিচের দিকে অবস্খান করে।
এদের আক্রমণে পাতা শক্ত চামড়ার মতো হয়ে কুঁকড়ে যায়।
ব্যাপক আক্রমণের ফলে সম্পূর্ণ পাতা হলুদ ও বাদামি রঙ ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন অনেক কমে যায়।
পটল ক্ষেত পরিষ্কার রাখতে হবে। ১ কেজি আধা ভাঙা নিমবীজ ১০ লিটার জলে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে ওই জল পাতার নিচের দিকে স্প্রে করতে হবে।
আক্রমণের হার বেশি হলে ওমাইট বা টলস্টার (প্রতি লিটার জলে ২ মিলি মিশিয়ে), ইবামেকটিন গ্রুপের ভার্টিমেক ১.২ মিলি/লিটার বা একামাইট ২ মিলি/ লিটার জলে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পরপর স্প্রে করতে হবে।
কাটলে পোকা (এপিল্যাকনা বিটল)
পূর্ণ বয়স্ক কাটলে পোকা এবং শুককীট দুই অবস্থায় পটলের গাছের ক্ষতি করে থাকে।
এ পোকা পাতার সবুজ অংশ খেয়ে জালের মতো ঝাঝড়া করে ফেলে।
পাতা শুকিয়ে গাছ পাতা শূন্য হয়ে পড়ে। আক্রমণের মাত্রা বেশী হলে গাছ মারা যেতে পারে।
আক্রমণের প্রাথমিক অবস্হায় পাতাসহ ডিমের গাদা বা পোকার গ্রাব হাত দিয়ে তুলে বা হাতজাল ব্যবহার করে ধ্বংস করতে হবে।
এর রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পটলের মাঠ সম্পূর্ণ পরিষ্কার ও আগাছামুক্ত রাখতে হবে।
৩০ থেকে ৪০ গ্রাম নিমবীজের মিহিগুঁড়া এক লিটার পানিতে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রেখে পানি ছেঁকে নিয়ে ওই পানি আক্রান্ত পাতাসহ সব গাছে স্প্রে করতে হবে।
এছাড়া ডাইক্লোরভস ১০০ ইসি এর ১ থেকে ২ মিলি বা কারবারিল ৮৫ ডব্লিউপি ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে বা ফেনিট্রিথিয়ন ৫০ ইসি ২ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে গাছের পাতা ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
শিকড়ের গিট রোগ
পটলে শিকড়ে গিট রোগ ( কৃমির আক্রমণে) মারাত্মক সমস্যা। ফলন মারাত্মক কমে যায়।
এ রোগের আক্রমণে গাছে ছোট-বড় অনেক গিঁটের সৃষ্টি হয়।
ফলে এদের মূল নষ্ট হয়ে খাবার নিতে পারে না। গাছ দুর্বল হয়ে খাটো হয়ে পড়ে।
এই রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচতে পটল বপনের ২০ থেকে ২৫ দিন আগে হেক্টর প্রতি মুরগির বিষ্ঠা ৩ থেকে ৫ টন বা সরিষার খৈল ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
এছাড়া ফুরাডান ৫ জি বা মিরাল ৩ জি, কুরাটার ৫ জি ৩০ থেকে ৪০ কেজি/হেক্টরও লতা লাগানোর সময় এবং পরবর্তী ৪ মাস পর পুনরায় প্রয়োগ করা হয়।
পাউডারি মিলডিউ
এ রোগে পাতার উপরে সাদা সাদা পাউডার দেখা যায় যা পাতা নষ্ট করে যায়।
পাতার ওপরের দিকে ও কাণ্ডে পাউডারের মতো ছত্রাকের জীবাণুর প্রলেপ পড়ে।
এতে ক্রমান্বয়ে কচি পাতা আক্রান্ত হয়। আক্রমণের প্রথম স্তরে দাগগুলো সাদা ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে সম্পূর্ণ পাতা শুকিয়ে যায়।
আক্রান্ত গাছের পরিত্যক্ত অংশ পুড়ে ফেলা। পরিমিত সার, সেচ প্রয়োগ। থিওভিট (০.২%) বা টিল্ট (০.১%) রোগ দেখা মাত্র ১৫ দিন অন্তর অন্তর স্প্রে করতে হবে।
কাণ্ডের রস ঝরা
শীতকালে পটোল গাছের কাণ্ড ফেটে যায় এবং এক ধরনের আঁঠালো পদার্থ নি:সৃত হয়।
এটা পরবর্তীকালে বাতাসের সংস্পর্শে এসে শক্ত হয়ে কাণ্ডের সাথে লেগে যায়।
রিডোমিল গোল্ড ২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রমণের সময় এবং ১০ থেকে ১৫ দিন পরপর তিনবার স্প্রে করা। বর্দোমিক্সার ব্যবহার করা।
ফসল সংগ্রহ
পটলের কচি ফল সকাল অথবা বিকালে সংগ্রহ করতে হয়।
সাধারণত জাতভেদে ফুল ফোটার ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে পটল সংগ্রহ করা যায়।
এমন ফসল সংগ্রহ করা উচিত যখন একটি পটল পূর্ণ আকার প্রাপ্ত হয়েছে কিন্তু বেশি পরিপক্ব হয়নি।
বেশি পরিপক্ব ফলের বীজ বেশি হয় এবং শক্ত হয়ে যায় বলেই ফসল খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যায়।
সপ্তাহে কমপক্ষে একবার ফল সংগ্রহ করতে হবে।
শেষ কথা
বাংলাদেশের জলবায়ু ও আবহাওয়া এবং প্রায় সব এলাকায় পটল চাষ করা যায়। বাজারে যখন অন্যান্য সবজির সরবরাহ কমে যায় তখন পটল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সুত্র: লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
আরো পড়ুন …
- ঝিঙ্গা চাষের সহজ পদ্ধতি ও রোগবালাই দমনে করণীয়
- জেনে নিন চিচিঙ্গা চাষের সহজ পদ্ধতি
- ধুন্দল চাষ ও রোগ-বালাই দমন পদ্ধতি জেনে নিন
- যেভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ করবেন
- চাল কুমড়া চাষের আধুনিক পদ্ধতি
- কোন মাসে কী ধরনের শাক-সবজি ও ফল চাষ করবেন
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।