কৃষি কথা

যেভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ করবেন

পেঁপে চাষ

আমাদের দেশে লাভজনক হওয়ায় অনেকেই এখন বাণিজ্যিকভাবে পেঁপে চাষ করছেন। কিন্তু বেশির ভাগ চাষি আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ না করায় পেঁপের ফলন তেমন পাচ্ছেন না।

আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করলে পেঁপের ফলন দ্বিগুণ পাওয়া সম্ভব।

স্বল্প মেয়াদী ফল পেঁপের চাষ করার জন্য বেশি জায়গারও প্রয়োজন নেই; বাড়ির আঙিনায় দুচারটি গাছ লাগালে সারাবছর ফলন পাওয়া যায়।

এবার জেনে নেওয়া যাক পেঁপে চাষের আধুনিক পদ্ধতি।

পেঁপে চাষ পদ্ধতি এবং রোগ ও প্রতিকার

জমি নির্বাচন

মোটামুটি সব রকমের মাটি পেঁপে চাষ করার উপযোগী। তবে, দোঁআশ কিংবা বেলে দোঁআশ মাটি পেঁপে চাষের জন্য সবচেয়ে উত্তম।

পেঁপে গাছ মোটেও জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না।

তাই, পেঁপের চারা বপনের জন্য যথা সম্ভব পানি নিষ্কাশন ও সেচ সুবিধাযুক্ত উচুঁ জায়গা নির্বাচন করতে হবে।

জমি তৈরী

পেঁপে চাষের আগে জমি বারবার চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে তৈরী করতে হবে।

পাশাপাশি দু’টি বেডের মাঝে ৩০সে.মি চওড়া এবং ২০ সে.মি. গভীর নালা থাকবে। নালাসহ প্রতিটি বেড ২মিটার চওড়া এবং জমি অনুযায়ী লম্বা হবে।

গর্ত তৈরী ও সার প্রয়োগ

উচ্চফলনশীল হাইব্রিড পেঁপে বীজ

উচ্চফলনশীল হাইব্রিড পেঁপে বীজ

চারা রোপণের ১৫ আগে বেডের মাঝ বরাবর ২ মিটার দূরত্বে চারিদিকে ২ ফুট পরিমান গর্ত তৈরি করে মাটিতে সার মিশাতে হবে।

প্রতি গর্তে ১৫ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম ইউরিয়া সার, ৫০০ গ্রাম টিএসপি, ৫০০ গ্রাম এমওপি সার, ২৫০ গ্রাম জিপসাম, ২০ গ্রাম বরিক এসিড এবং ২০ গ্রাম জিংক সালফেট সার প্রয়োগ করেতে হবে।

ইউরিয়া ও এমওপি সার ছাড়া সব সার গর্ত তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে।  এরপর সার মিশ্রিত গর্তে সেচ দিতে হবে।

চারা লাগানোর পর গাচে নতুন পাতা আসলে ইউরিয়া ও এমওপি সার ৫০ গ্রাম করে প্রতি ১ মাস পর পর প্রয়োগ করতে হয়। গাছে ফুল আসলে ১০০ গ্রাম করতে হবে।

মাটিতে যথেষ্ট রস না থাকলে সার দেওয়ার পর সেচ দিতে হবে।

চারা তৈরি ও রোপণ

পেঁপের চার বীজতলা ও পলিথিন ব্যাগে তৈরি করা যায়। বীজ থেকে চারা তৈরি করা সময় লক্ষ্য রাখতে হবে; যাতে বীজ বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা হয়।

প্রতি হেক্টরের জন্য ১৫০-৩০০ গ্রাম বীজের দরকার। তবে হাইব্রিড পেঁপের জন্য ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম বীজই যথেষ্ট।

বীজতলায় চারা তৈরির ক্ষেত্রে ১০-১৫ সেন্টিমিটার সারি করে প্রতি সারিতে ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার গভীরে বীজ বপন করতে হবে।

পলিথিন ব্যাগে চার তৈরি করলে রোপণের পর চারা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

পেঁপে বীজ বপনের ১৫ – ২০ দিন পর চারা বের হয়। এই চারা গুলো ৪০ -৫০ দিন পর তা রোপণের উপযোগী হয়।

প্রতি গর্তে ২-৩টি করে চার রোপণ করার পর; ফুল আসলে ১ টি স্ত্রী গাছ রেখে বাকি গাছ তুলে ফেলতে হবে। পরাগায়ণের জন্য প্রতিটি বাগানে ১০% পুরুষ গাছ থাকা দরকার।

আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ এ সফলতা পেতে বীজ বপন ও চারা লাগাবার ভাল সময়, আশ্বিন এবং পৌষ মাস। বীজ বপনের ৪০ থেকে ৫০ দিন পর অর্থাৎ মাঘ-ফাল্গুণ মাসে চারা রোপণের উপযোগী হয়।

বীজ তলায় উৎপাদিত চারার উন্মুক্ত পাতাগুলো রোপণের আগে ফেলে দিলে রোপণ করা চারার মৃত্যু হার হ্রাস পায় এবং চারা দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়।

পলিব্যাগে উৎপাদিত চারার ক্ষেত্রে পলিব্যাগটি খুব সাবধানে অপসারণ করতে হবে, যাতে মাটির বলটি ভেঙে না যায়।

রোপণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে চারার গোড়া বীজতলা বা পলিব্যাগে মাটির যতটা গভীরে ছিল তার চেয়ে গভীরে না যায়।

পড়ন্ত বিকেলে চারা রোপণের জন্য উত্তম সময়।

পরিচর্যা

পেঁপে চাষ পদ্ধতি

পেঁপে গাছ

আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁপে চাষে সফলতা পেতে অবশ্যই পরিচর্যার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

পেঁপে চাষের জমি সব সময় আগাছামুক্ত রাখার পাশা-পাশি গাছের গোড়ার মাটি কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে।

তবে বর্ষা মৌসুমে আগাছা দমন করতে গিয়ে মাটি যাতে বেশি আলগা না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

পেঁপের ফলন ও আকার সেচের উপর নির্ভর করে। তাই শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজন অনুযায়ী পানি সেচ দিতে হবে।

সেচের ও বৃষ্টির পানি যাতে জমিতে জমে না থাকে সে জন্য পানি নিকাশের সুব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া পেঁপে গাছ যাতে ঝড়ে না ভেঙ্গে যায় তার জন্য বাঁশের খুঁটি দিয়ে গাছ বেঁধে দিতে হয়।

পেঁপের অধিকাংশ জাতের ক্ষেত্রে একটি পত্রক থেকে একাধিক ফুল আসে এবং ফল ধরে।

ফল কিছুটা বড় হওয়ার পর প্রতি পত্রকক্ষে সবচেয়ে ভালো ফলটি রেখে বাকিগুলো ছিঁড়ে ফেলতে হবে।

দ্বিতীয় বা তার পরবর্তী বছরে যে পেঁপে হয় সেগুলো ঠাসাঠাসি অবস্থায় থাকে।

ফলে ঠিকমতো বাড়তে পারে না এবং এদের আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ছোট ফলগুলো ছাঁটাই করতে হবে।

পেঁপের রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন

পেঁপ গাছে রোগবালাইয়ের মধ্যে ঢলেপড়া ও কাণ্ডপচা, এ্যানথ্রাকনোজ, মোজাইক ও পাতা কোঁকড়ানো রোগ অন্যতম। এছাড়া পোকার মধ্যে মিলিবাগ উল্লেখযোগ্য।

পেঁপের ড্যাম্পিং অফ রোগ দমন

এ রোগটি সাধারণত চারা অবস্থায় অথবা বীজ গজানোর সময় হয়ে থাকে। মাটিতে যে ছত্রাক থাকে তার দ্বারা এ রোগ হতে পারে।

বীজের অংকুর গজানোর সময় এ রোগের জীবাণু অতি সহজেই বীজ অথবা অংকুরকে আক্রমণ করে।

এ অবস্থায় বীজ পচে যায় এবং চারা মাটির উপর বের হয়ে আসতে পারেনা।

এভাবে অংকুর গজানোর আগেই পচন হতে পারে। চারা গজানোর পরেও জীবাণুর আক্রমণ ঘটে।

এ পর্যায়ে চারার গোড়া বা শিকড় পচে গিয়ে আক্রান্ত চারা মাটিতে পড়ে যায় এবং মারা যায়। চারার বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ রোগের প্রকোপ কমে যায়।

ঢলে পড়া ও কাণ্ড পঁচা রোগ

মাটি স্যাঁতস্যাঁতে থাকলে বীজতলায় চারায় ঢলে পড়া রোগ দেখা দিতে পারে। এছাড়া বর্ষাকালে কাণ্ডপচা রোগ দেখা দিতে পারে।

বৃষ্টির পানিতে অথবা সেচের পানিতে এ রোগের জীবাণু ছড়ায়। কাণ্ডপচা রোগ হলে গাছের গোড়ায় বাদামী বর্ণের পানি ভেজা দাগের সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত চারা গাছ মারা যায় এবং ঢলে পড়ে।

এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা হিসেবে গাছের গোড়ার পানি নিকাশের ভাল ব্যবস্থা রাখা দরকার।

এছাড়া বীজতলার মাটি বীজ বোনার আগে শুকনা রাখতে হবে এবং সিকিউর নামক ছত্রাক নাশক ২ থেকে ৩ গ্রাম প্রতি কেজি বীজের সাথে মিশিয়ে শোধন করতে হবে।

এ রোগের প্রতিকার হিসেবে রোগাক্রান্ত চারা গাছ মাটি থেকে উঠিয়ে পুড়ে ফেলতে হবে।

আক্রমন বেশি হলে রিডোমিল এমজেড-৭২ প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭ দিন পর পর গাছের গোড়ার চারিদিকের মাটিতে প্রয়োগ করা দরকার।

জিংকের ঘাটতির জন্য মোজাইক লক্ষণ দেখা দিলে গাছের গোড়ায় গাছপ্রতি ৫-১০ গ্রাম জিংক প্রয়োগ করলে এবং ০.২% জিংক গাছের পাতায় স্প্রে করলে এ সমস্যা কমে যায়।

মোজাইক রোগ

এটি ভাইরাস জনিতএকটি রোগ। এ রোগের কারণে পেঁপে গাছের পাতায় হলুদ রং এর ছোপ ছোপ দাগ দেখা যায়।

পাতার বেঁটা বেঁকে থাকে এবং গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। যাব পোকার আক্রমণে এরোগ বিস্তার লাভ করে।

আক্রান্ত গাছ তুলে মাটিতে পুতে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

রোগ বিস্তার করা পোকা দমন করে এ রোগের বিস্তার রোধ করা সম্ভব।

এজন্য নোভাস্টার ৫৬ইসি ০২ মিলি বা হেমিডর বা পিমিডর বা এডমায়ার ২০০ এসএল ০১ মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫-৭ দিন স্প্রে করতে হবে।

মিলিবাগ পোকা

বর্তমান সময়ে মিলিবাগ পেঁপের একটি ক্ষতিকর পোকা হিসাবে আর্বিরভাব হয়েছে।

এ পোকার আক্রমণে গাছের পাতা ও ফর শুটি মোল্ড রোগের সৃষ্টি হয়। আক্রান্ত পাতা ও ফলে সাদা পাউডারের মতো আবরণ পড়ে।

আক্রমণের মাত্র বেশি মাত্রায় হলে গাছ মারা যেতে পারে।

আক্রমণের প্রথম দিকে আক্রান্ত পাতা ও ফল বা কাণ্ড সংগ্রহ করে মাটিতে পুতে বা আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করতে হবে।

আক্রমণ বেশি হলে এডমায়ার ২০০এসএল ০.২৫ মি.লি. হারে বা সাবানের পানি ৫ গ্রাম মিশিয়ে ৫-৭ দিন পরপর ৩-৪ বার স্প্রে করতে হবে।

ফসল তোলা

সবজি হিসেবে কচি ফল সংগ্রহ করা হয়। পাকানোর জন্য ফলের ত্বক হালকা হলুদ বর্ণ ধারণ করলে সংগ্রহ করতে হয়। বৈশাখ থেকে শ্রাবন মাস পর্যন্ত বাজারে পেঁপের দাম ভালো পাওয়া যায়।

শেষ কথা

চারা লাগাবার ৮-১০ মাসের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। উপযুক্ত নিয়মে ও পেঁপে চাষ করার নিয়মগুলো অনুশরণ করলে হেক্টর প্রতি ৪০ থেকে ৬০ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *