দেশের সহজলভ্য সবজি চাল কুমড়া। গ্রামাঞ্চলে ঘরের চালে এর চাষাবাদ হয় বলে এই নামে পরিচিত পায় চাল কুমড়া।
এখন ছাদেও এটির চাষাবাদ হচ্ছে। তবে জমিতে (মাচায়) এর ফলন বেশি হয়।
বাংলাদেশে চাল কুমড়ার কোনো অনুমোদিত জাত নেই। তবে, বাজারে বিভিন্ন কোম্পানীর ভাল হাইব্রিড চাল কুমড়া বীজ পাওয়া যাচ্ছে।
এছাড়া, বারি কর্তৃক উদ্ভাবিত বারি চালকুমড়া-১ নামের জাতটি দেশের সব অঞ্চলে চাষ করা যায়।
চাল কুমড়া চাষ পদ্ধতি
চালকুমড়া চাষের আগে মাটি নির্বাচন করতে হবে। এটি জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ মাটিতে চাষ করা হয়।
উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাদা মাটি ছাড়া যে কোনো মাটিতে চালকুমড়ার চাষ করা যায়। এছাড়া চরাঞ্চলে পলি মাটিতে এটির ভালো ফলন হয়।
তবে…
- চালকুমড়ার ভালো ফলনের জন্য উঞ্চ, পর্যাপ্ত সূর্যালোক এবং নিম্ন আর্দ্রতা প্রয়োজন।
- চালকুমড়া চাষের জন্য অনুকূল তাপমাত্রা হলো ২০-২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
চাষাবাদের সময়ে উচ্চ তাপমাত্রা ও লম্বা দিন হলে চালকুমড়ার স্ত্রী ফুলের সংখ্যা কমে যায়। পুরুষ ফুলের সংখ্যা বেড়ে যাবার কারণে ফলন কমে যায় সম্ভাবনা থাকে।
চালকুমড়া চাষের উপযুক্ত সময়
আমাদের দেশে চালকুমড়া চাষের জন্য সবচেয়ে উত্তম ফেব্রুয়ারি থেকে আগষ্ট পর্যন্ত। তবে এখন সারাবছরই চালকুমড়া চাষ করা হয়।
জমি তৈরি এবং বীজের হার
প্রতি একর জমির জন্য ১৫০-২০০ গ্রাম চাল কুমড়া বীজ প্রয়োজন। জমি তৈরির ক্ষেত্রে সেচ ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত এবং প্রচুর সূর্যালোক পায় এমন জমি নির্বাচন করে ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে ঢিলা ভেঙে সমান করতে হবে।
জমিতে মাদার উচ্চতা হবে ১৫-২০ সে.মি., প্রস্থ হবে ২.৫ মিটার এবং লম্বা জমি সুবিধামতো নিতে হবে। এভাবে পরপর মাদা তৈরি করতে হবে।
এরূপ পাশাপাশি দুইটি মাদার মাঝখানে ৬০ সে.মি. প্রশস্ত সেচ ও নিকাশ নালা থাকবে। এছাড়া, জমিতে কোন ঢিলা বা আগাছা না থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
উঠানে বা ছাদ বাগানে চাল কুমড়ার চাষ করতে হলে মাদায় বোনার পর গাছ বুনে গাছ মাচা, ঘরের চাল কিংবা কোনো বৃক্ষের উপর তুলে দেওয়া যায়।
মাদায় সার প্রয়োগ:
- উঠানে বা ছাদ বাগানে প্রতি মাদায় গোবর ১০ কেজি, টিএসপি ২০০ গ্রাম, এমপি ৫০ গ্রাম দিতে হবে।
- প্রতি শতাংশে গোবর যত দেওয়া যায় তত ভাল। এছাড়া ইউরিয়া ১০-১২ কেজি, টিএসপি ৮-১০ কেজি, মিউরেট অব পটাশ ৩-৫ কেজি, জিপসাম ৩ কেজি, জিংক অক্সাইড ১০০-১৫০ দিতে হবে।
- ইউরিয়া সার ছাড়া অন্যান্য সব সার বীজ বোনার ৭-৮ দিন আগে মাদার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
বীজ বপনের পদ্ধতি
চাল কুমড়া বীজ বপনের পূর্বে রোদে শুকানোর পর ৮-১০ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে নিলে অঙ্কুরোদগম ভাল হয়। তবে, চারা নার্সারিতে পলিব্যাগে উৎপাদন করে নিলে ভালো হয় সেক্ষেত্রে ৮-১০ সেমি আকারের পলিব্যাগ ব্যবহার করা যায়।
যা করতে হবে
- প্রথমে অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক গোবর দিয়ে পলিব্যাগ ভরে নিতে হবে।
- প্রতি ব্যাগে একটি করে বীজ বুনতে হবে।
- বীজের আকারের দ্বিগুন মাটির নিচে বীজ পুঁতে দিতে হবে।
- পলিব্যাগে চারা করলে বীজ গজানোর ১০-১২ দিন পর চারা জমিতে রোপন করতে হবে।
এছাড়াও মাদা তৈরী করে সরাসরি বীজ মাদাতে রোপন করা যায়। প্রতিটি মাদায় সারিতে ৪ থেকে ৫টি বীজ বপন করতে হবে। ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যেই বীজগুলো গজাবে। চারা গজানোর কয়েকদিন পর প্রতি মাদায় ২-৩টি সবল গাছ রেখে বাকি গুলো তুুলে ফেলতে হবে।
মাদার আকার
- ব্যাস ৫০-৫৫ সেমি, গভীরতা ৫০-৫৫ সেমি এবং তলদেশের ব্যাস ৪০-৪৫ সেমি।
- এক্ষেত্রে সারি থেকে সারি ২ মিটার এবং প্রতি সারিতে ২ মিটার পর পর বীজ বপন করে হবে।
- ২-৩ সেমি গভীরে প্রতি মাদায় ২ টি করে বীজ বপন করতে হবে এবং চারা গজানোর ৭ দিন পর সুস্থ চারাটি রেখে বাকিটা তুুলে ফেলতে হবে।
চাল কুমড়া গাছের রোগ বালাই দমন
পোকা, মাছি, পিল্যাকনা বিটল, রেড পামকিন বিটল, ইলাল মাকড় প্রভৃতি পোকা চালকুমড়ার ক্ষতি করে থাকে। কীটনাশক প্রয়োগ করে এসব পোকা দমন করা যায়।
এছাড়া পাউডারি মিলডিও পাতার উপরে সাদা পাউডার এবং ডাউনি মিলডিউ পাতার নিচে ধূসর বেগুনি রং প্রভৃতি রোগ পাতার ক্ষতি করে গাছকে দুর্বল করে ফেলে।
ছত্রাক নাশক বা বোর্দো মিক্সার প্রয়োগ করে এসব রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
- রেড পামকিন বিটল পাতার কিনারা থেকে খাওয়া শুরু করে সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে। এই পোকা বয়স্ক গাছের পাতার শিরা উপশিরা রেখে সম্পূর্ণ সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে
- ডগা ছিদ্রকারী পোকা প্রথমে এরা গাছের ডগার উপর ছোট একটা ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে যায় এবং পরবর্তীতে সম্পূণ ডগাটি খেয়ে ফেলে।
- কুমড়া চাষের প্রধান শত্রু “মাছি” পোকা। আবাদকৃত কুমড়ার ফুলে ও ফলে এই পোকা বসলে কুমড়া লাল হয়ে নষ্ট হয়ে যায়।
এই পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সেক্স ফেরোমন পদ্ধতি ব্যবহার করে পোকা নিধন করা, পোকা দেখা মাত্র মেরে ফেলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ করা, পোকা মারার ফাঁদ তৈরি করা এবং বিষটোপ ব্যবহার করা।
কৃত্রিম পরাগায়ন
চাল কুমড়া গাছে ফল ধরার জন্য পুরুষ ও স্ত্রী ফুলের মধ্যে পরাগায়ন অত্যাবশ্যক। পুরুষ ফুলের পরাগধানীতে পরাগরেণু থাকে।
পরাগায়নের জন্য পরাগরেণু স্ত্রী ফুলের গর্ভমুলে স্থানান্তরিত হতে হবে এবং ফল ধারণ করবে।
যদি সঠিকভাবে পরাগায়ন হয়ে থাকে তাহলে ফুলটি একটা নির্দিষ্ট সময় পরে ঝরে যাবে এবং কুমড়াটি বাড়তে থাকবে।
পরাগায়ন না হলে কচি ফলটি শুকিয়ে যায়, পচে যায় এবং ঝরে পড়ে।
ফসল সংগ্রহ
চাল কুমড়া গাছ লাগানোর ৬০-৭০ দিনের মধ্যে ফল দেওয়া শুরু করে। চাল কুমড়া সবজি হিসেবে খেতে হলে সবুজ হুল যুক্ত ৪০০-৬০০ গ্রাম হলে তুলতে হবে। মোরব্বা বা বড়ি দেওয়ার জন্য পরিপক্ক করে ১২০-১৩০ দিন পর তুলতে হবে।
শেষ কথা
নিয়ম মেনে চালকুমড়ার চাষ করতে পারলে ছাদে, ঘরের চালে কিংবা জামিতে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
আরো পড়ুন …
- তরমুজ চাষের সহজ পদ্ধতি ও সঠিক পরিচর্যা
- কোন মাসে কী ধরনের শাক-সবজি ও ফল চাষ করবেন
- জেনে নিন ঢেঁড়শ চাষ পদ্ধতি, পোকামাকড় ও রোগবালাই দমনে করণীয়
- একসাথে বেগুন ও শসার চাষের পদ্ধতি
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” এ ।