কৃষি কথা

লাউ চাষের সহজ পদ্ধতি ও পরিচর্যার সঠিক নিয়ম

লাউ চাষ

বর্তমানে লাউ চাষে আধুনিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণে; ফলন বৃদ্ধির পাশাপাশি লাভবান হচ্ছে কৃষক।

শীতকালে লাউয়ের ফলন বেশি হয়। তবে উচ্চতাপ ও অতিবৃষ্টি সহিষ্ণু ফলে লাউয়ের চাষাবাদ সারা বছর করা যায়।

তবে আপনার এলাকায় কোন জাতের লাউয়ের ( লম্বা না গোল) চাহিদা, সে অনুযায়ী লাউ বীজ বপন করতে হবে।

যে জাতের লাউ এর চাহিদা বেশি সেই জাতের চাষ করলে লাভবান বেশি হবেন।

এবার জেনে নিন লাউ চাষের শুরু করার আগে কোন কোন বিষয় আপনার মাথায় রাখতে হবে।

লাউ চাষ পদ্ধতি

জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ, এঁটেল বা বেলে দো-আঁশ মাটির উঁচু জমি লাউ চাষের জন্য উত্তম।

যেহেতু এটেল মাটি পানি ধরে রাখে, তাই খরা মৌসুমে এটেল মাটিতে লাউয়ের চাষাবাদ ভাল হয়।

বাংলাদেশে শীতও বেশি না, গরমও বেশি না এমন আবহাওয়া লাউয়ের চাষাবাদের বেশি উপযোগী।

শীতকালটা লাউ চাষের জন্য উত্তম। তবে, শীতকালীন আগাম লাউয়ের চাষাবাদ জন্য ভাদ্রের প্রথমে এই সবজির চাষ করা ভাল।

শীতকালে তাপমাত্রা কখনো ১০০ সে. এর নিচে নেমে গেলে, তা লাউয়ের চাষাবাদের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। দিন ও রাতে তাপমাত্রার পার্থক্য ৮-৯০ হলে ভালো।

জমি ও মাদা তৈরী

লাউ চাষের জন্য জমি নির্বাচন করতে হবে সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায় এমন।

লাউ গাছের শিকড় ব্যাপক বৃদ্ধির জন্য উত্তমরূপে জমি ৩-৪ বার চাষ ও মাই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। যাতে সহজে শেকড় অনেক দুর যেতে পারে।

লাউয়ের চাশাবাদে গোবর বা জৈব সারের ব্যাপক ব্যবহারে ভালো ফলন পাওয়া যায়।

তবে এগুলো জমিতে চাষের আগে প্রয়োগ করে বেড তৈরি করা উত্তম। বেড তৈরি ও বেড থেকে বেডের দূরত্ব…

  • বেডের উচ্চতা হবে ১৫-২০ সেমি.।

    উচ্চফলনশীল গোল লাউ বীজ (হাইব্রিড)

    উচ্চফলনশীল গোল লাউ বীজ (হাইব্রিড)

  • বেডের প্রস্থ হবে ২.৫ মিটার এবং লম্বা জমির দৈর্ঘ্য অনুসারে নিতে হবে।
  • এভাবে পরপর বেড তৈরি করতে হবে।
  • এরূপ পাশাপাশি ২টি বেড়ের মাঝখানে ৬০ সেমি. ব্যাসের সেচ নালা থাকবে।
  • এবং প্রতি ২ বেড অন্তর ৩০ সেমি প্রশস্ত শুধু নিকাশ নালা থাকবে।

মাদা তৈরি এবং মাদার দূরত্ব

  • মাদার আকার হবে ব্যাস ৫০-৫৫ সেমি. গভীরতা ৫০-৫৫ সেমি. এবং তলদেশ ৪৫-৫০ সেমি.।
  • বেডের যে দিকে ৬০ সেমি. প্রশস্ত সেচ ও নিকাশ নালা থাকবে সেদিকে বেডের কিনারা হতে ৬০ সেমি. বাদ দিয়ে মাদার কেন্দ্র ধরে ২ মিটর অন্তর এক সারিতে মাদা তৈরি করতে হবে।
  • একটি বেরের যে কিনারা হতে ৬০ সেমি. বাদ দেয়া হবে, তার পার্শ্ববর্তী বেডের ঠিক একই কিনার থেকে ৬০ সেমি. বাদ দিয়ে মাদার কেন্দ্র ধরে অনুরূপ নিয়মে মাদা করতে হবে।

সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ

দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা লাউ গাছ ফলন পাওয়া যায় লম্বা সময়কাল ধরে। এ জন্য লাউয়ের চাষা সফলতা পেতে গাছের জন্য পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ নিশ্চির করতে হবে।

লাউ চাষের জন্য জমি তৈরির সময় সারের যে মাত্রা সুপারিশ করা হয়েছে, তার মধ্যে গোবর চাষের পর এবং টিএসপি, এমপি, জিপসাম ও বোরক্স সার শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।

মাদায় চারা রোপণের যে সারের মাত্রা সুপারিশ করা হয়েছে তা দেওয়ার পর পানি দিয়ে মাদার মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।

তারপর ‘জো’ এলে ৭-১০ দিন পর চারা লাগাতে হবে।

প্রতি মাদায় ২০০ গ্রাম টিএসপি + ১০০ গ্রাম জিপসাম + ৫০ গ্রাম এমওপি + (জিংক, বোরন, ম্যাগনেসিয়াম, কার্বোফুরান ১৫-২০ গ্রাম হারে দেয়া যায়)। আর বেশি বেশি গোবর বা জৈব সার দিলে অতি উত্তম।

লাউয়ের চারা তৈরী ও বপন পদ্ধতি

লাউ বীজ সরাসরি জমিতে বপন করা যায়। তবে চারা তৈরী করেও বপন করা উত্তম।

চারা তৈরী করে রোপনে নিরাপত্তা, সময় কম ও ফলন বেশি হয়।

প্রথমে বীজ ২-১ ঘন্টা রোদ্রে রেখে তা ছায়ায় ঠান্ডা করে নিতে হবে। এর পর ২০-২৫ ঘন্টা পানিতে রেখে দিতে হবে।

শেষ ১০ মিনিট ২ গ্রাম/ লিটার পানিতে কার্বেন্ডাজিম দিয়ে শোধন করে নিতে পারেন।

এর পর সবচেয়ে ভালো হয় বীজগুলো গরম কাপড়/ ছালার চট ভিজিয়ে তাতে পেচিয়ে ২ দিন অপেক্ষা করা।

দুই দিনে বীজ ফেটে শেকড় বের হলে তা সাবধানে পলিব্যাগে বপন করতে হবে।

মাটিতে রস না থাকলে সামান্য একটু পানি দিতে হবে।

পলিব্যগে ২ ভাগ এটেল মাটির সাথে ১ ভাগ পচা ঝুরঝুরে গোবর মিক্স করে নিতে হবে।

অতিরিক্ত পানি বের হওয়ার জন্য পলি ব্যগের নিচে ফুটো করে নিতে হবে। পলিব্যাগে রোপনের ৩ দিন পর গাছ বের হবে।

গাছ বের হওয়ার ১৫-১৭ দিন পর চারা গাছের ৩-৪ টা পাতা আসলে তা রোপনের উপযুক্ত হবে।

রোপনের আগ পর্যন্ত গাছগুলো আদা-ছায়ায় রাখতে হবে।

মাদা প্রতি ২-৩ টি চারা রোপন অথবা ৩-৪ টি বীজ বপন করতে হবে।

পরবর্তীতে মাদায় ২-১ টি গাছ রাখলেই চলবে। জমি শুকনো থাকলে চারা রোপন করে পানি দিতে হবে।

প্রখর রৌদ্র থাকলে রোপনকৃত চারা কিছু দিয়ে রোদ থেকে আড়াল করে রাখতে হবে।

চারা পরিচর্যা

লাউ বীজ

আয়মন ১ লাউ বীজ কিনুন

বিটল পোকা এসে পাতা খেয়ে নিলে ছাই, কেরোসিন+পানি, অথবা সাইপারমেথ্রিন/ক্লোরপাইরিফস হালকা করে স্প্রে করতে হবে অথবা মশারি দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।

১৫ দিন পর ২ কেজী ইউরিয়া ও দেড় কেজী এমওপি সার (এই হারে) মিক্স করে প্রতি মাদায় ২-৩ মুঠ করে গোড়া থেকে ৬ ইঞ্চি দুরে গোল করে দিয়ে নিড়ানি দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।

গাছ লতা নিতে শুরু করলে বাশের কঞ্চি বা শক্ত কাঠি দিতে হবে।

লাউ গাছের মাচা তৈরী

মাচায় লাউ চাষে কাঙ্খিত ফলন পাবেন। আর মাটিতে চাষ করলে ফলের একদিক বিবর্ণ হয়ে বাজারমূল্য কমে যায়, ফলে পচন ধরে এবং প্রাকৃতিক পরাগায়ন কমে যাওয়ার ফলে ফলনও কমে যায়।

লাউয়ের গাছ অনেক ভারি, তাই মাচা মজবুত করে দিতে হবে যতে ভারিতে ভেঙে না পড়ে।

এছাড়া চারিদিকে টানা দিয়ে রাখতে হবে।

লাউ গাছের পরিচর্যা

লাউয়ের অধিক ফলন পাওয়ার জন্য অধিক পরিচর্যা করতে হয়। লাউ গাছ মাচায় ওঠার সময় গোড়া থেকে অনেক শোষক শাখা বের হয়।

লাউ গাছের গোড়ার দিকে ছোট ছোট ডালপালা হয়। সেগুলোকে শোষক শাখা বলা হয়। এগুলো গাছের ফলনে এবং যথাযথ শারীরিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। কাজেই এই ডালপালাগুলো ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে অপসারণ করতে হবে।.

ঠিক মত পরাগায়নে  প্রচুর লাউয়ের ফলন হয়।  গাছে মাচা ভর্তি হয়ে গেলে গাছের পাতা কেটে দিয়ে আবার নতুন করে ফলন নেয়া যায়। তবে পাতা কেটে ছত্রাকনাষক স্প্রে করতে হবে।

লাউ ফসল পানির প্রতি খুবই সংবেদনশীল। প্রয়োজনীয় পানির অভার হলে ফল ধারণ ব্যাহত হবে এবং ফল আস্তে আস্তে ঝরে যাবে। তাই খরার সময় ৪-৫ দিন পর পর পানি দিতে হয়। মাটি স্যাতস্যতে অবস্থায় রাখলে খুব ভালো হয়।

সেচের পর জমিতে চটা বাঁধলে গাছের শিকড় অঞ্চলে বাতাস চলাচল ব্যাহত হয়।

কাজেই প্রত্যেক সেচের জর হালকা মালচ, করে গাছের গোড়ার মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে।

কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির ঘাস লাউতে বোটল গোর্ড মোজাইক ভাইরাসের আক্রমনের অন্যতম কারণ।

তাই চারা লাগানো থেকে শুরু করে ফল সংগ্রহ পর্যন্ত জমি সব সময়ই আগাছামুক্ত রাখতে হবে।

এ ছাড়াও গাছের গোড়ায় আগাছা থাকলে তা খাদ্যোপাদান ও রস শোষণ করে নেয়।

পোকামাকড় ও রোগ বালাই দমন

ফলের মাছি পোকা অভিপজিটর ঢুকিয়ে কচি লাউ এ কিড়া ছেড়ে দেয়।

তাই কচি লাউ মারা যায়। এর জন্য ফেরমন বা সপ্তাহে দুই-এক বার সাইপারমেথ্রিন স্প্রে করতে হবে।

লাউ গাছে ক্ষুদ্র শোষক পোকাও দেখা যায়। এরা ভাইরাসের বাহক।

তাই সপ্তাহে ২-১ বার ইমিডাক্লোরপ্রিড স্প্রে করতে হবে।

এছাড়া ল্যাদা পোকা জাতীয় সবুজ পোকা কচি পাতা কুরে খেয়ে ফেলে বা লাউ এর ত্বক নষ্ট করে। এর জন্য মাঝে মাঝে এমামেকটিন বেনজয়েড স্প্রে করতে হবে।

সাদা মাছি, জাব পোকা, থ্রিপস পোকা ইত্যাদি শোষক পোকার আক্রমনে লাউ গাছে মোজাইক ভাইরাস হতে পারে।

গাছের পাতা কিছুটা কুকড়ে যায় ও হলুদ-সবুজ ছোপ ছোপ দেখায়। ফলের রং ও আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়।

এ রোগ প্রতিকার সম্ভব নয়, তাই গাছ তুলে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। বাহক পোকা দমন করার জন্য ইমিডাক্লোরপ্রিড স্প্রে করতে হবে।

লাউ গাছে ডাওনি মিলডিউ বা পাউডারী মিলডিউ রোগ দেখা যায়। পাওডারী মিলডিও রোগে পাতার উপর ক্ষুদ্র সাদা পাওয়ার দেখা যায়।

কার্বপন্ডাজিম বা ক্যবরিওটপ অথবা অন্যান্য ছত্রাকনাষক ব্যবহার করে এ রোগ ঠিক করা যায়।

ছত্রাকনাষক স্প্রে করলে লাউ এর পচনজনিত রোগও ঠিক হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। লাউ এর রং ও খুব সুন্দর ও আকর্ষনীয় হয়।

গাছের শেকড়ে নেমাটোডা বা কৃমির আক্রমনে শেকড়ে গিটের সৃষ্টি হলে গোড়ায় সামান্য কার্বোফুরান দিতে হবে।

ফলন

লাউ কচি অবস্থায় সংগ্রহ করতে হয়। পরাগায়নের ১৫ দিন পরই লাউ খাওয়ার উপযুক্ত হয়।

উপযুক্ত হলে সাথে সাথে কেটে মাচা পাতলা করে দিতে হবে। এতে ফলন বৃদ্ধি পাবে।

শেষ কথা

একই জমিতে বার বার একই ফসলের চাষ পরিহার করতে পারলে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের উপদ্রব কমানো যাবে।

সুত্র: লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।

আরো পড়ুন … 

**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )”  হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা  টেলিগ্রাম চ্যানেল  ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *