বাণিজ্যিক চাহিদা কারণে বাংলাদেশে রজনীগন্ধা ফুল চাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। চাহিদার দিক দিয়ে এবং বানিজ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে এ মনোরম ও সুগন্ধি ফুলের জুড়ি নেই।
রজনীগন্ধা ফুলের আকার ও পাঁপড়ির উপর ভিত্তি করে ৩ শ্রেণীর ( সিংগেল, সেমি-ডাবল ও ডাবল ) এই ফুল পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে সিঙ্গেল ও ডাবল এই ২ জাতের রজনীগন্ধা দেখা যায়। তবে এখন পর্যন্ত কোন জাত উদ্ভাবিত হয়নি।
আজ আমরা রজনীগন্ধা ফুল চাষ পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব এই নিবন্ধে।
কিভাবে সহজ উপায়ে রজনীগন্ধা ফুল চাষ করবেন
মার্চ থেকে এপ্রিল মাস রজনীগন্ধা ফুল চাষ করা যায়। সব ধরনের মাটিতে এই ফুল চাষ করা গেলেও, সুনিষ্কাশিত উঁচু ও মাঝারি উঁচু জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দো-আঁশ মাটির জমি রজনীগন্ধা ফুল চাষের উত্তম।
- সেচ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে এবং pH মান ৬.৫ -৭.৫ আছে এমন জমিতে এই ফুল ভালো জন্মে।
- রজনীগন্ধা গাছের উপযুক্ত বৃদ্ধির জন্য গড় তাপমাত্রা ২০-৩০০ সেন্টিগ্রেড ও আর্দ্র আবহাওয়ার প্রয়োজন।
- আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে রজনীগন্ধা ফুলের চাষ করা হয়।
- পর্যাপ্ত সূর্যোলোকসহ উপকূলীয় এলাকা ও বর্ষাকাল উৎপাদনের উপযুক্ত সময়।
- শীতকালে রজনীগন্ধা ফুলের উৎপাদন কমে যায়।
- তবে সেমি ডবল ও ডবল জাত শীতকালেও ফুল দিতে থাকে।
জমি তৈরি ও কন্দ রোপন
বংশবিস্তার বীজ ও কন্দ উভয় মাধ্যমে হয়ে থাকলেও, এ দেশে মুলত কন্দ দ্বারাই রজনীগন্ধা ফুলের চাষাবাদ করা হয়। কারণ কন্দ থেকে উৎপন্ন গাছে মাতৃ গাছের সব রকম গুণাগুণ বজায় থাকে।
এছাড়া…
- সাধারনত মাঝারী থেকে বড় আকারের কন্দ বংশবিস্তারের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
- বড় ধরনের কন্দ থেকে স্বাস্থ্যবান গাছ হয় ও গাছে তাড়াতাড়ি ফুল আসে।
- কিন্তু ছোট কন্দ থেকে দূর্বল প্রকৃতির গাছ হয় ও দেরীতে ফুল আসে।
- রজনীগন্ধা চাষের জন্য জমি ৪-৫ বার ৮-১০ ইঞ্চি গভীর করে চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরে ও সমান মাটি প্রস্তুত করতে হবে।
- এরপর চাষাবাদের জমিতে গোবর, কম্পোস্ট, টিএসপি, এমপি ইত্যাদি সার ভালোভাবে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
- বর্ষার পানি নিষ্কাশনের জন্য বেড তৈরি করে কন্দ রোপন করতে হবে।
- বেড তৈরির ৫ থেকে ৭ দিন পর ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার অন্তর অন্তর সারি তৈরি করতে হবে।
- প্রতি সারিতে ১০-১৫ সেন্টিমিটার অন্তর অন্তর কন্দ রোপণ করতে হয়।
- কন্দ ৭-১০ সে:মি সেন্টিমিটার মাটির গভীরে লাগানো উচিত।
- কন্দ এমনভাবে রোপন করতে হবে যাতে এর অগ্রভাগ ঠিক মাটির নিচে সমতলে অবস্থান করে।
- রবি মৌসুমে মধ্য আশ্বিন হতে কার্ত্তিকের শেষ (অক্টোবর হতে মধ্য নভেম্বর) পর্যন্ত কন্দ লাগানোর উপযুক্ত সময়।
- খরিফ মৌসুমে ১লা চৈত্র থেকে বৈশাখের মাঝামাঝি (মধ্য মার্চ থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত) কন্দ লাগানোর উপযুক্ত সময়।
- মাটিতে রসের অভাব থাকলে কন্দ লাগানোর পূর্বে সেচ প্রদান করা উচিত।
- এছাড়া কন্দ রোপণের পর মাটিতে কন্দ বসার জন্য হালকা সেচ দেওয়া ভাল।
কন্দ রোপণের আগে কন্দের সুপ্তাবস্থা (যে সময়টুকুতে বীজ গজাবে না তাকেই সুপ্তাবস্থা বলে) কাটানোর জন্য কন্দ গুলোকে ৪ শতাংশ থায়ো ইউরিয়া জলীয় দ্রবনে প্রায় ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে পারেন।
সার প্রয়োগ
জমি তৈরির সময়, শেষ বার চাষে হেক্টর প্রতি উর্বরতা ভেদে ।।
- ৫-১০ টন গোবর,
- ২৫০ কেজি ফসফেট,
- এবং ২০০ কেজি এম পি সার মাটির সাথে ভাল ভাবে মিশিয়ে দিতে হবে।
- এছাড়া ভালো মানের ফুলের জন্য হেক্টর প্রতি ১২ কেজি বরিক এসিড।
- এবং ৮ কেজি জিন্ক সালফেট প্রয়োগ করতে হবে।
জমি তৈরীর কাজ চারা লাগাবার অন্তত ১৫ দিন আগে শেষ করতে হবে। কন্দ রোপনের ১৫ থেকে ২০ দিন পর যখন নতুন গাছের বৃদ্ধি শুরু হয় তখন হেক্টর প্রতি ৩০০ কেজি ইউরিয়া সারের অর্ধেকটা প্রথম উপরি প্রয়োগ এবং বাকী অর্ধেক পুষ্পদন্ড বের হওয়ার সময় উপরি প্রয়োগ করা উচিত।
সেচ ও পরিচর্যা
রজনীগন্ধা ফুল চাষ এর জমি নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে আগাছা পরিষ্কারের সময় কন্দের যেন কোন ক্ষতি না হয়।
- নিড়ানী দেওয়ার ফলে গাছ আলো, বাতাস ও পানি সহজেই পেতে পারে।
- নিড়ানীর ফলে জমির আর্দ্রতার ধারন ক্ষমতা বাড়ে এবং আগাছা মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
- প্রয়োজনে আগাছা দমনে একর প্রতি ১.৮ কেজি অনুমোদিত আগাছানাশক স্প্রে করতে পারেন।
- এছাড়া রজনীগন্ধার জমির মাটিতে সবসময় রস থাকা উচিত।
- গ্রীষ্মকালে ৭ দিন অন্তর অন্তর এবং শীতকালে ১০ দিন পরপর সেচ দেওয়া উচিত।
- শুকনো মৌসুমে প্রয়োজন মত সেচ দিতে হবে।
- এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি সুনিস্কাশনের জন্য নিস্কাশন নালা তৈরি করতে হবে।
- গাছের গোড়া থেকে শুকনো বা মরা পাতা সরিয়ে ফেলা উচিত।
- শীতকালে গাছের উপরের অংশ সম্পূর্ন ভাবে কেটে দেয়া ভাল।
পোকা-মাকড়, রোগবালাই দমন
রজনীগন্ধা গাছে এফিড, থ্রিপস পোকা দমনের জন্য ২মিলি লিটার ম্যালাথিয়ন প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করা ভাল।
এছাড়া বোট্রাইটিস পাতায় দাগ ও ব্লাইট রোগ বর্ষা মৌসুমে দেখা যায়।
- প্রথমে আক্রান্ত ফুলে গাড় বাদামী রং এর দাগ পড়ে এবং পড়ে সমস্ত পুষ্পমঞ্জুরী শুকিয়ে যায়।
- পাতায় এবং কান্ডেও এই রোগের প্রকোপ দেখা যায়।
এই রোগ দমনে রোভরাল (ম্যানকোজেব) .২% হারে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।
ধ্বসা রোগ রোগের ফলে গাছের শিঁকড়ে পচন ধরে। শেষে গাছের পাতা খসে যায় এবং ফুলের মঞ্জরীগুলো মাটিতে ঢলে পড়ে।
আক্রান্ত গাছগুলো তুলে ফেলে ধ্বংস করতে হবে। আক্রমণ বেশি হলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়।
টবে রজনীগন্ধা ফুল চাষ
বড় টবে রজনীগন্ধা ফুল চাষ করা যায়। উপযুক্ত টব মিশ্রণ দিয়ে পাশাপাশি কয়েকটি কন্দ লাগিয়ে নিয়মিত সেচ ও মাঝে মাঝে সামান্য খৈল ও গোবর পচানো মিশ্রণ দিলে উন্নত মানের ফুল পাওয়া যায়।
- ছাদে বা টবে রজনীগন্ধার চাষের ক্ষেত্রে প্রথমে গাছের সাথে মানানসই সাইজের টব সংগ্রহ করতে হবে।
- তবে ছোট গাছের জন্য বড় টব হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু বড় গাছের জন্য ছোট টব চলবে না।
- টবে চাষের ক্ষেত্রে ২ ভাগ মাটি, ১ ভাগ পাতা পচা সার, ১ ভাগ পচা গোবর সার মিশিয়ে টব ভরে নিতে হবে।
- এর সাথে একমুঠো হাড়ের গুঁড়ো, দুই চা-চামচ চুন, দু মুঠো ছাই মেশাতে পারলে ভালো হয়; এতে টবের মাটি দীর্ঘদিন উর্বর থাকবে।
- প্রতি টবে ১-২টি কন্দ রোপন করা যাবে।
- চারা রোপনের পর আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে গোড়ার মাটি শক্ত করে দিয়ে গোড়ায় পানি দিতে হবে।
- চারা রোপনের কয়েক দিন ছায়ায় রেখতে হবে, এ অবস্থায় সকালে ও বিকেলে রোদ নিয়ে যাওয়া উত্তম।
ফলন ও ফুল সংগ্রহ
রজনীগন্ধার কন্দ রোপনের পর জাতভেদে ৭০-৯০ দিনের মধ্যে গাছে স্টিক আসতে শুরু করে। স্টিক কাটার সময় ধারালো ছুরি ব্যবহার করতে হবে।
রজনীগন্ধার একই ক্ষেত থেকে পরপর ৩ বছর ফুল উৎপাদন করা যায়। তাই স্টিক কাটার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে এটি যেন মাটি থেকে ১.৫-২.৫ ইঞ্চি উপরে থাকে।
প্রতি একরে ১৫- ২০ হাজার রজনীগন্ধার স্টিক উৎপাদন হয়।
–বগ্লে প্রকাশিত কোনও তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
আরো পড়ুন …
- সঠিক ডালিয়া ফুল চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা
- চন্দ্রমল্লিকা ফুল চাষ, সঠিক ও সহজ পদ্ধতি জেনে নিন
- সঠিক ও সহজ জুঁই ফুল চাষ পদ্ধতি শিখে নিন
- ভিন দেশি টিউলিপ ফুল চাষ, সঠিক পদ্ধতি জেনে নিন
- অর্কিড ফুল চাষ, জেনে নিন আধুনিক পদ্ধতি
- জবা ফুল চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।