বাংলাদেশে চাষযোগ্য জমি ও বাড়ির আঙিনায় বর্ষজীবী লতানো উদ্ভিদ মিষ্টি কুমড়া চাষ হয় ব্যাপকভাবে। প্রায় সারা বছর এই সবজির চাষবাদ করা যায়।
বৈশাখী, বর্ষাতি ও মাঘী তিন শ্রেণিতে বিভক্ত মিষ্টি কুমড়া। কচি ফল সবজি হিসেবে এবং পাকা ফল দীর্ঘদিন রেখে সবজি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
শুধু সবজি হিসেবে নয় মিষ্টি কুমড়ার বীজে রয়েছে প্রচুর পুষ্টি ও ওষুধি গুণ।
মিষ্টি কুমড়া চাষ পদ্ধতি
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় মিষ্টি কুমড়ার বীজ বছরের যে কোনো সময় বোনা যায়।
শীত মৌসুমে মিষ্টি কুমড়া চাষ করতে চাইলে অক্টোবর – ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বীজ বপন করা উত্তম।
আর গ্রীষ্মকালে এই বর্ষজীবী সবজির চাষবাদ করতে চাইলে ফেব্রুয়ারি – মার্চ মাস পর্যন্ত বীজ বোনার উপযুক্ত সময়।
উন্নত ফলন পেতে হলে নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে বীজ বোনা উচিত।
মিষ্টি কুমড়ার চাষের জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু প্রয়োজন। সুনিষ্কাশিত জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোঁ-আশ বা এঁটেল দোঁ-আশ মাটি এর চাষাবাদের জন্য উৎকৃষ্ট। তবে চরাঞ্চলের পলি মাটিতে মিষ্টি কুমড়ার ফলন ভালো হয়।
তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে চলে গেলে গাছের দৈহিক বৃদ্ধির হার অনেক কমে যায়।
জমি তৈরি ও বীজ বপন
বাড়ির আঙিনায় মিষ্টি কুমড়া চাষ করতে চাইলে সুবিধাজনক জায়গায় দু’একটি মাদায় বীজ বুনে গাছ মাচা, ঘরের চাল কিংবা কোন গাছের উপর তুলে দেয়া যেতে পারে।
জমিতে চাষাবাদের ক্ষেত্রে সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায় এমন স্থান নির্বাচন করতে হবে।
মিষ্টি কুমড়া গাছের শিকড় ব্যাপক বৃদ্ধির জন্য উত্তমরূপে জমি ৩-৪ বার চাষ ও মাই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। যাতে সহজে শেকড় অনেক দুর যেতে পারে।
তারপর…
- ১৫-২০ সেমি উঁচু এবং ২.৫ মি বাই ৮মি প্লট তৈরি করে নিতে হবে।
- প্রতিটি প্লটে ২ মিটার পর পর ৪৫ বাই ৪৫ বাই ৪০ সেমি আকারের পিট তাতে বীজ বপন করতে হবে।
- মাদার জন্য সাধারণত ৩-৪ মিটার দূরত্বে ৮০-১০০ ঘন সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে।
- ৬:৪ অনুপাতে দোআঁশ মাটির সঙ্গে গোবর-ছাই মিশিয়ে নিয়ে বীজতলা তৈরি করে নিতে হবে ৷
প্রতিটি প্লটের মাঝে পানি নিষ্কাশনের জন্য সরু নালী এবং জমির চারপাশে অপেক্ষাকৃত মোটা নালী তৈরি করে রাখতে হবে। যাতে প্রয়োজনে পানি নিষ্কাশন করা যায়।
পলিব্যাগে বীজ বপন ও চারা উৎপাদন…
- চারা সাধারনত পলিব্যাগে তৈরি করা হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিতে চারা তৈরি করা ভাল।
- পলিব্যাগে মিষ্টি কুমড়ার চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ৩X৪ ইঞ্চি (৮X১০(সে.মি) আকারের পলিব্যাগ ব্যবহার করা হয়।
- অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশনের জন্য ছিদ্রযুক্ত পলিব্যাগে ব্যবহার করতে হবে।
- প্রথমে অর্ধেক মাটি ও অর্ধেক গোবর মিশিয়ে মাটি তৈরি করে নিতে হবে।
- মাটিতে বীজ গজানোর জন্য “জো” নিশ্চিত করে (মাটিতে “জো” না থাকলে পানি দিয়ে “জো” করে নিতে হবে) তা পলিব্যাগে ভরতে হবে।
- অতঃপর প্রতি ব্যাগে দুইটি করে বীজ বুনতে হবে। বীজের আকারের দ্বিগুণ মাটির গভীরে বীজ পুঁতে দিতে হবে।
- বীজ গজানোর পর ১৫-১৬ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর জন্য উত্তম।
পলিব্যাগের ভাঁজ বরাবর ব্লেড দিয়ে কেটে পলিব্যাগ সরিয়ে মাটির দলাসহ চারাটি নির্দিষ্ট জায়গায় লাগিয়ে চারপাশে মাটি দিয়ে ভরাট করে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর গর্তে পানি দিতে হবে।
মিষ্টি কুমড়া চাষের জন্য শতাংশ প্রতি ২.৫ গ্রাম পরিমাণ বীজের প্রয়োজন হয়।
সার ব্যবহার ও প্রয়োগ পদ্ধতি
মিষ্টি কুমড়ার ভালো ফলন পাওয়া জন্য (মাটির গুণগতমান পরীক্ষা করে) মাটির উর্বরতার উপর নির্ভর করে জমিতে সার প্রয়োগ করা দরকার।
আমাদের দেশের পেক্ষাপটে প্রতিটি পিটে সার ব্যবহার করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
তবে পরিবেশ এবং মাটির স্বাস্থ্য ভাল রাখতে সব সময় জৈব সার ব্যবহার করা উচিত ।
বীজ বপনের প্রায় ১০-১৫ দিন আগে প্রতিটি প্লটে গোবর, টিএসপি, এমপি, জিপসাম মাটির সাথে ভালোভাবে মিশ্রিত করে পিট তৈরি করতে হবে।
বীজ অঙ্কুরিত হলে ১৫-২০ দিন পর প্রতিটি পিটে ২০ গ্রাম ইউরিয়া সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
তবে মাদার ক্ষেত্রে প্রতি গর্তে গোবর বা কমপোস্ট ৫ কেজি, ইউরিয়া ১৩০ গ্রাম, টিএসপি ২০০ গ্রাম, এমপি ১৫০ গ্রাম, জিপসাম ৯০ গ্রাম ও দসত্মা সার ৫ গ্রাম দিতে হবে।
ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার বীজ বোনার ৮-১০ দিন আগে গর্তের মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
ইউরিয়া দুইভাগে বীজ বোনার ১০ দিন পর প্রথমবার ও ৩৫ দিন পর দ্বিতীয়বার উপরি প্রয়োগ করতে হবে। মাদার চারপাশে অগভীর একটি নালা কেটে সার নালার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
সারের পরিমাণ (কেজি শতাংশ)
সেচ ও পরিচর্যা
মিষ্টি কুমড়া গাছের বৃদ্ধি ও ভালো ফলন পেতে মাটিতে রস থাকার প্রয়োজন।
তাই শুষ্ক আবহাওয়ায় ৫-৬ দিন পর পর হালকা সেচ দিতে হবে।
তবে ফল তোলার তিন সপ্তাহ আগেই সেচ দেওয়া বন্ধ করে দিতে হবে।
অপরদিকে সেচ বা বৃষ্টির পানি যাতে বেশি দিন গাছের গোড়ায় জমে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার করে চারা গাছের গোড়ায় কিছুটা মাটি তুলে দিতে হবে।
মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে।
গাছের গোড়ার কাছাকাছি কিছু খড় ১৫-২০ দিন পর বিছিয়ে দিতে হবে। ফল ধরা শুরু করলে ফলের নিচেও খড় বিছিয়ে দিতে হবে। বৈশাখী কুমড়া মাটিতে হয়, অন্যান্য কুমড়ার জন্য মাচার ব্যবস্থা করতে হয়। গাছের লতাপাতা বেশি হলে কিছু লতাপাতা ছেঁটে দিতে হবে।
পোকামাকড় ও রোগ দমন
কুমড়া জাতীয় গাছে লাল পোকা, কাঁটালে পোকা এবং ফলের মাছির আক্রমণ উল্লেখ্যযোগ্য। এছাড়া এ জাতীয় সবজিতে পাউডারি মিলডিও, ডাউনি মিলডিও ও এনথ্রাকনোজ প্রধান রোগ।
মিষ্টি কুমড়ায় মাছিপোকা আক্রমণ
মিষ্টি কুমড়ার কচিফল ও ফুলের মধ্যে এই পোকা প্রথমে ডিম পাড়ে।
পরবর্তীতে ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফল ও ফুলের ভিতর কুরে কুরে খায় যার ফলে ফল ও ফুল পচন ধরে নষ্ট হয়ে যায়।
এই পোকার আক্রমণের ফলে প্রায় ৫০-৭০ ভাগ ফল নষ্ট হয়ে যায়।
মাছিপোকা দমনের জন্য আক্রান্ত মিষ্টি কুমড়ার কচিফল সংগ্রহ করে তা নষ্ট করে ফেলতে হবে।
এছাড়া সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ও বিষটোপ মাছির আক্রমণ থেকে মিষ্টি কুমড়ার কচিফল রক্ষায় অত্যন্ত কার্যকর।
রেড পামকিন বিটলের আক্রমণ
পামকিন বিটল ফুল ও কচি ফলেও আক্রমণ করে। এ পোকা পূর্ণবয়স্কপোকা চারা গাছের পাতায় ফুটো করে এবং পাতার কিনারা থেকে খাওয়া শুরু করে সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে।
চারা আক্রান্ত হলে পামকিন বিটল দমনে হাত দিয়ে পূর্ণবয়স্ক পোকা ধরে মেরে ফেলে।
জাবপোকার আক্রমণ
জাবপোকার আক্রমণে মিষ্টি কুমড়ার বাড়ন্ত ডগা ও পাতা হলুদ হয়ে যায়।
গাছ তার সতেজতা হারিয়ে ফেলে এবং ফলন গুরুতর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক জাবপোকা দলবদ্ধভাবে গাছের পাতার রস চুষে খায়।
ফলে পাতা বিকৃত হয়ে যায়, বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ও প্রায়শ নিচের দিকে কোঁকড়ানো দেখা যায়।
মেঘলা, কুয়াশাচ্ছন্ন এবং ঠান্ডা আবহাওয়ায় জাবপোকার বংশ বৃদ্ধি বেশি হয়।
প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হলে এদের সংখ্যা কমে যায়।
প্রাথমিক অবস্থায় জাবপোকার দমনে আক্রান্ত পাতা ও ডগার জাবপোকা হাত দিয়ে পিষে মেরে ফেলা যায়।
নিমবীজের দ্রবণ বা সাবানগোলা পানি সেপ্র করেও এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমে যায়।
বন্ধু পোকাসমূহ সংরক্ষণ করলে এ পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কম হয়।
সাদা গুঁড়া রোগ বা পাউডারি মিলডিউ
রোগের প্রারম্ভে গাছের নিচের বয়স্ক পাতায় রোগের লৰণ প্রকাশ পায়।
ক্রমশ উপরের পাতায় রোগ ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে পাতার উপর বিক্ষিপ্ত সাদা সাদা দাগের সৃষ্টি হয়।
রোগ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দাগ আকারে বড় হতে থাকে এবং হলুদ বর্ণ থেকে বাদামী রঙ ধারণ করে।
রোগের প্রকোপ বেশি হলে গাছের লতা ও কান্ড আক্রান্ত হয়। ধীরে ধীরে সেই লতা ও পরে পুরো গাছই মরে যেতে পারে।
এই রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য লাউ ও কুমড়াজাতীয় আগাছা বিনাশ করতে হবে।
জমির আশে-পাশে কুমড়া জাতীয় যে কোন সবজি চাষ থেকে বিরত থাকা।
আগাম চাষ করে রোগের প্রকোপ কমানো যায়।
প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইনসাফ/থিয়ভিট বা সালফোলাঙ/কুমুলাস অথবা ১০ গ্রাম ক্যালিঙিন ১৫ দিন পর পর সেপ্র করে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা।
ডাউনি মিলডিউ
ডাউনি মিলডিউ শুধু পাতায় হয়। আক্রান্ত পাতায় নানা আকারের দাগ পড়ে।
সাধারণত দাগগুলি কোণাকৃতি ও হলদে হয়।
দাগগুলি খুব তাড়াতাড়ি সংখ্যায় বৃদ্ধি পায় ও আকারে বড়ো হয়।
পাতার নিচে দিকে দাগের উপরে বেগুনি রংয়ের ছত্রাক জন্মে।
ডাউনি মিলডিউ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য লাউ ও কুমড়াজাতীয় আগাছা বিনাশ করতে হবে।
জমির আশেপাশে কুমড়া জাতীয় যে কোনো সবজি চাষ থেকে বিরত থাকা।
আগাম চাষ করে রোগের প্রকোপ কমানো যায়।
ফসল সংগ্রহ
মিষ্টি কুমড়ার বীজ বোনার দু’মাসের মধ্যে কুমড়ার গাছ ফল ধরতে শুরু করে এবং রোগাক্রান্ত না হলে আড়াই মাস ব্যাপি ফলন সংগ্রহ করা যাবে।
পরাগায়নের ১০-১৫ দিনের মধ্যে ফল সবজি হিসেবে খাওয়ার উপযোগী হয়।
তবে কুমড়ার ফল সংগ্রহের সুনির্দিষ্ট কোন পর্যায় নেই। ব্যবহারের উদ্দেশ্য অনুযায়ী অপক্ক ও পরিপক্ক ফসল সংগ্রহ করা যাবে।
শেষ কথা
মিষ্টি কুমড়ায় বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেলর নির্দেশাবলি মেনে চলুন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফল কমপক্ষে ৭ থেকে ১৫ দিন পর বাজারজাত করা উত্তম।
সুত্র: লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
আরো পড়ুন …
- লাউ চাষের সহজ পদ্ধতি ও পরিচর্যার সঠিক নিয়ম
- জেনে নিন পটল চাষের সঠিক পদ্ধতি ও পরামর্শ
- ঝিঙ্গা চাষের সহজ পদ্ধতি ও রোগবালাই দমনে করণীয়
- জেনে নিন চিচিঙ্গা চাষের সহজ পদ্ধতি
- ধুন্দল চাষ ও রোগ-বালাই দমন পদ্ধতি জেনে নিন
- কোন মাসে কী ধরনের শাক-সবজি ও ফল চাষ করবেন
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।