ঢেঁড়শ বপনের সময় ফাল্গুন–চৈত্র মাস। বীজ বোনার আগে কয়েক ঘণ্টা ভিজিয়ে নিলে ভাল। ভালোভাবে মাটি ঝুরঝুরে করে চাষের জমি তৈরি করতে হয়। প্রতিটি সারির দুরত্ব হবে ৩০ ইঞ্চি; সারিতে ১৮ ইঞ্চি দূরে দূরে ২-৩ টি করে বীজ বুনতে হয়।
গ্রীষ্মকালীন জনপ্রিয় সবজি ঢেঁড়শে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি ও সি রয়েছে। এছাড়া পর্যাপ্ত আয়োডিন, ভিটামিন এ এবং বিভিন্ন খনিজ পদার্থ রয়েছে।
তাই ঢেঁড়শ চাষে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে শারীরিক উপকারিতাও রয়েছে। হাইব্রিড বা সংকর জাতের ঢেঁড়শ গ্রীষ্মকাল ছাড়াও প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায়।
ঢেঁড়শ চাষের জন্য সব সময় নতুন বীজ ব্যবহার করা ভাল। এতে কৃষক লাভবান হবে। ঢেঁড়শ চাষের জন্য প্রথম আলো-বাতাস পায় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে। জমি উঁচু হবে এবং পানি নিকাশের ভাল সুবিধা থাকতে হবে।
আসুন জেনে নেই ঢেঁড়শ চাষের নিয়ম-
ঢেঁড়শ বা ভেণ্ডী সারা বছর চাষ করা যায়। তবে গ্রীষ্মকাল চাষের উপযুক্ত সময়। ফাল্গুন-চৈত্র ও আশ্বিন-কার্তিক মাস বীজ বোনার উপযুক্ত সময়।
ঢেঁড়শ বপনের জন্য প্রতি শতকে ২০ গ্রাম এবং প্রতি হেক্টরে ৪-৫ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। দো-আশ ও বেলে দো-আশ মাটি ঢেঁড়শ চাষের জন্য ভালো।
পানি নিষ্কাশনের সুবিধা থাকলে এটেল মাটিতেও চাষ করা যায়। শাউনি, পারবনি কানি, বারি ঢেঁড়শ, পুশা সাওয়ানি, পেন্টা গ্রিন, কাবুলি ডোয়ার্ফ, জাপানি প্যাসিফিক গ্রিন চাষ উপযোগী জাত।
ঢেঁড়শ চাষ: জলবায়ু ও মৃত্তিকা
- দীর্ঘস্থায়ী উষ্ণ আবহাওয়া ঢেঁড়শ চাষের পক্ষে অনুকূল। গ্রীষ্মকালেই অধিক পরিমাণে ঢেঁড়স চাষ হয়। দীর্ঘস্থায়ী ঠাণ্ডা আবহাওয়া ও তুষারপাতে ঢেঁড়শ গাছ বাঁচে না।
- ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর কম উষ্ণতায় ঢেঁড়শ বীজ অঙ্কুরিত হয় না। গ্রীষ্ম ছাড়াও বর্ষাকালে, এমনকি বৃষ্টিবহুল অঞ্চলেও হাইব্রিড ঢেঁড়শ বা ভেণ্ডী চাষ করা যায়।
- জৈব পদার্থ যুক্ত হালকা দো-আঁশ মাটি ঢেঁড়শ চাষের পক্ষে আদর্শ হলেও প্রায় সবরকম মাটিতেই এর চাষ করা যায়। সামান্য অম্লত্ব সহনশীল হলেও ক্ষার বা নোনামাটিতে ঢেঁড়শ ভালো হয় না।
- ফাল্গুন মাস থেকে শুরু করে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত হাইব্রিড ঢেঁড়শ বীজ বোনা যায়।
বীজ বোনার পদ্ধতি:
ঢেঁড়শ বীজ বপণের আগে ১০ থেকে ১৩ ঘণ্টা পানিতে ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। মাটি গভীরভাবে চাষ ও মই দিয়ে ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হয়।
এরপর সারি তৈরি করতে হবে। মাটি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৭৫ সেন্টিমিটার।
বীজ সারিতে ৪৫ সেন্টিমিটার দূরে দূরে ২-৩টি করে বীজ বুনতে হয়। জাত অনুযায়ী চারা থেকে চারা এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ১৫ সেন্টিমিটার কমানো-বাড়ানো যায়।
শীতকালে গাছ ছোট হয় বলে দূরত্ব কমানো যেতে পারে। চারা গজানোর পর প্রতি গর্তে একটি করে সুস্থ চারা রেখে বাকি চারা গর্ত থেকে উঠিয়ে ফেলতে হয়।
- গ্রীষ্মকালের চেয়ে বর্ষাকালে অপেক্ষাকৃত কম বীজ লাগে। দেশী বীজ বিঘা প্রতি ১-২ কেজি এবং হাইব্রিড বীজ-বিঘা প্রতি ৫০০-৭৫০ গ্রাম।
- গ্রীষ্মকালে গাছের বৃদ্ধি অপেক্ষাকৃত কম হয়। গ্রীষ্মকালে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৬০ সেমি. (২ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৪৫ সেমি. (১.৫ ফুট)। বর্ষাকালে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৭৫ সেমি. (২.৫ ফুট) এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ৪৫ সেমি. থেকে ৬০ সেমি (১.৫-২ ফুট)।
- জমি গভীরভাবে চাষ ও মই দিয়ে মাটির সাথে গোবর সার ভালোভাবে মিশিয়ে ৭ দিন পরে দূরত্ব অনুযায়ী সারিতে ১টি বা ২টি করে বীজ ১ সেমি. গভীরে বীজ বুনতে হবে।
- বীজ বসানোর আগে ১২-২৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুরোদগম ভালো হবে এবং তাড়াতাড়ি ও সুষমভাবে চারা বের হবে।
- ভেণ্ডী বীজ ২ গ্রাম কার্বেণ্ডাজিম প্রতি কেজি বীজে মিশিয়ে বীজ শোধন করে নিতে হবে।
- বীজ বোনার পর হালকা সেচ দিতে হবে এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেন জমি খুব বেশি ভিজে না যায় বা খুব বেশি শুকিয়ে না যায় ৷
- দেশী জাতের ঢেঁড়শের মধ্যে পার্বণী ক্রান্তি ও সাতশিরা কিছু পরিমাণে সাহেবরোগ সহনক্ষম। তবে, বর্ষাকালের জন্য হাইব্রিড জাতের ঢেঁড়শ বা ভেণ্ডী চাষ করা উত্তম।
ঢেঁড়শ চাষে সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা :
ঢেঁড়শ বীজ বোনার আগে জমি চাষের সময় বিঘাপ্রতি ১০ কুইন্টাল শুকনো গোবর অথবা পচন সার, ৪০ কিলোগ্রাম সুপার ফসফেট ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে মাটির সাথে।
জমিতে বীজ রোপণের ৪০ দিন পর বিঘাপ্রতি ৬ কিলোগ্রাম ইউরিয়া সার মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
ঢেঁড়শের চারাগুলো ৫ -৬ ইঞ্চি হয়ে যাওয়ার পর প্রতি চারায় ২০ গ্রাম পরিমাণে কেঁচো সার সারির দু’দিক থেকে গোঁড়ায় দিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দিলে অধিক ফলন পাওয়া যায়।
এছাড়া অধিক ঢেঁড়শ উৎপাদনের জন্য এজটবেকটার ও সফটিকা নামক জীবাণু সারও ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে বিঘাপ্রতি ফলন ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাবে।
পোকামাকড় ঠেকাতে মাটিতে শেষ চাষের সময় বিঘাপ্রতি আড়াই কিলোগ্রাম ম্যালাথিয়ন ৫ শতাংশ গুঁড়ো কীটনাশক মিশিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া চাষের সময় নিমপাতা মেশালেও মাটিতে থাকা কীটপতঙ্গ দমন হবে।
- বীজ বোনার একমাস পরে বিঘা প্রতি ৫ কেজি হারে নাইট্রোজেন সার প্ররো করে চারার গোড়ায় মাটি দিয়ে গোড়া বেঁধে দিতে হবে ও সেচ দিতে হবে।
- প্রথম চাপান সার প্রয়োগের তিন সপ্তাহ পরে দ্বিতী চাপান হিসাবে পুনরায় ৫ কেজি করে নাইট্রোজেন ও পটাশ প্রয়োগ করতে হবে এবং সেচ দিতে হবে।
- মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে এবং গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে। প্রয়োজন মতো ৭-১০ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে।
- বীজ বোনার ৫০-৬০ দিনের মাথায় ফসল তোলা শুরু হয়। প্রতি ৩/৪ দিন অস্তর ছুরি দিয়ে বোঁটা কেটে ভেণ্ডী তোলা উচিত। রাত্রের দিকে ফলের বৃদ্ধি ভালো হয়।
- কালে ফসল তোলা অধিক লাভজনক ৷ সযত্ন ও পরিচ্ছন্ন চাষ করা সত্ত্বেও নানা রোগ-পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে, প্রয়োজন অনুযায়ী ফসল সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে।
পোকা- মাকড় ও রোগ-বালাই দমন
হলুদ শিরা মোজেইক বা সাহেব রোগ
ভেণ্ডী চাষের প্রধান সমস্যা হলো এই সাহেব রোগ। এটি একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ।
পাতার শিরা হলুদ ও বর্ণহী হয়ে যায়, শিরা-উপশিরাগুলি মোটা হয়ে যায় এবং কখনও কখনও শিরা-মধ্যবর্তী অংশও হলুদ হয়ে বিবর্ণ হয়ে যায়; এবং পাতাগুলো হলুদ ছাপ ছাপ দেখায়, গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়, ফল ছোটো ছোটো, ফ্যাকাসে রঙের, বিকৃত আকার-আকৃতি লাভ করে।
এই রোগের প্রতিকার: কার্বোসালফান (০.২%) বা ইমিডাক্লোপ্রিড (০.০২%) পর্যায়ক্রমে স্প্রে করলে সাদামাছি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তবে, ওষুধ স্প্রে করার পর কমপক্ষে ৭ দিন ফল তোলা যাবে না।
এছাড়া, ফলন্ত গাছে তামাকপাতা সাবান জল মিশ্রণ স্প্রে করে সাদা মাছির প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
ঝিমিয়ে পড়া রোগ :
ছত্রাকঘটিত এই রোগের আক্রমণে গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করেও বেঁটে হয়ে যায়, পাতা পুড়ে যায় ও গাছ ঝিমিয়ে পড়ে, অবশেষে মরে যায়।
অনেক সময় গাছ সতেজ থাকে, কিন্তু অগ্রমুকুল এবং কচিফল শুকিয়ে যায়।রোগাক্রান্ত গাছের মূল বা কাণ্ড লম্বালম্বিভাবে কাটলে ভিতরে কালোকালো লম্বা দাগ দেখা যায়।
খুব বাড়াবাড়ি হলে পুরো কাণ্ডই কালো হয়ে যায়।
এই রোগের প্রতিকার: শস্যচক্র মেনে চাষ, রোগাক্রান্ত গাছের মূলসহ তুলে ফেলা, গ্রীষ্মকালে গভীর চাষ-এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান উপায়।
এছাড়া, রোগের সম্ভাবনা দেখা দিলে ২.৫ গ্রাম প্রতিলিটার হিসাবে ম্যানকোজেব এবং ১ গ্রাম প্রতিলিটার হিসাবে কার্বেন্ডাজিম জলে গুলে পর্যায়ক্রমে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
পাতায় দাগ :
পাতায় গোলগোল জলবসা দাগ দেখা যায়। দাগ ক্রমশঃ কালচে রং ধারণ করে, পাতা গুটিয়ে যায়, ঝিমিয়ে পড়ে এবং ঝুলে পড়ে। ছত্রাকঘটিত রোগ এটি।
এই রোগের প্রতিকার: এ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য ঝিমিয়ে পড়া রোগে যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, সেই একই ওষুধ একই মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।
নিমাটোড :
আক্রান্ত গাছের শিকড়ে গাঁট গাঁট ফোলা অংশ দেখা যায়, গাছ ঝিমিয়ে পড়ে, বৃদ্ধি কমে যায় এবং ফলন হল না। সরাসরি নিমাটোড নামক আণুবীক্ষণিক কৃমি জাতীয় জীবটিকে মেরে ফেলা প্রায় অসম্ভব।
এই রোগের প্রতিকার: কার্বোফিউরান জাতীয় ওষুধ সারের সঙ্গে মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করে এই রোগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
এছাড়া, আক্রান্ত জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ করে এবং তিন বছর শস্যচক্রে ভেণ্ডীর চাষ করে নিমাটোডের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব।
চোষী পোকা :
অতি ক্ষুদ্র পোকা কচি পাতার রস শোষণ করে। ফলে, পাতাগুলি ক্রমশঃ বাদামি রং ধারণ করে কুঁকড়ে যায় ৷ গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে ও বৃদ্ধি কমে যায়।
এই রোগের প্রতিকার: ফুল আসার আগে পর্যন্ত ডাইমিথয়েট প্রতিলিটার জলে ২ মিলিলিটার হারে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
মাকড় :
অতি ক্ষুদ্র হলুদ ও লাল মাকড় পাতার নিচে বাসা বাঁধে ও রস শোষণ করে গাছকে দুর্বল করে দেয়। আক্রান্ত পাতা হলুদাভ হয়ে নিচের দিকে কুঁকড়ে যায়, ফুল ও ফল ধরে না।
এই রোগের প্রতিকার: আক্রান্ত গাছে ফুল আসার আগে ডাইকোফল ১.৫ মিলি/লি. জলে এবং ফলন্ত গাছে ইথিয়ন ১ মিলি/লি. জলে গুলে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
ফল ছিদ্রকারী পোকা :
ছোটো ছোটো কীড়া ফল ছিদ্র করে ফলের মধ্যে বাস করে ও ফল খেয়ে নষ্ট করে। অনেক সময় কচি ডগা ছিদ্র করে ফসলের প্রভূত ক্ষতি সাধন করে।
এই রোগের প্রতিকার: সন্ধ্যার পর কুইনালফস ২ মিলি. প্রতিলিটার জলে গুলে ৭ দিন অন্তর স্প্রে করলে এই পোকা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এছাড়া, থায়োডিকার্ব ১মিলি/লি. জলে গুলে ৭ ১০দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে।
শেষ কথা:
বীজ বুনার প্রায় ১২০-১৩০ দিনের মধ্যে ঢেঁড়সগুলো শুকিয়ে লম্বালম্বিভাবে ফাটতে শুরু করে। ঢেঁড়স শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধারালো ছুরি দিয়ে পাকা ফলগুলো সংগ্রহ করে ও রোদে ভালো করে শুকিয়ে মাড়াই করার পর বীজ ঠান্ডা করে প্লাষ্টিক ব্যাগে ভরে রাখতে হবে।
বীজ হিসাবে চাষাবাদে ফলন হয় ১০০-১৫০ কেজি/ হেক্টর।
আরও পড়ুন-