গ্রীষ্মকালীন জনপ্রিয় সবজি ঝিঙ্গা উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া এবং প্রচুর সূর্যালোক থাকে এমন এলাকায় চাষের জন্য উত্তম। এছাড়া ঝিঙ্গার ভালো ফলনের জন্য সুনিষ্কাশিত উচ্চ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোঁআশ মাটি সর্বোৎকৃষ্ট।
দেশে সব এলাকায় ঝিঙ্গা চাষ যায়, সঠিক পদ্ধতিতে ঝিঙ্গার চাষাবাদে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব।
এবার জেনে নেওয়া যাক ঝিঙ্গা চাষের উন্নত পদ্ধতি।
ঝিঙ্গা চাষের সহজ পদ্ধতি
বর্তমানে দেশি ঝিঙা, হাইব্রিড দুই জাতের ঝিঙ্গা চাষ হচ্ছে দেশে। দেশী জাতের ঝিঙ্গা আকারে ছোট, ফলনও কম।
অপর দিকে হাইব্রিড ঝিঙ্গা আকার বড়, সুস্বাদু এবং নরম ও রসালো।
বীজ বোনার সময় ও বীজের পরিমাণ
বাংলাদেশে মূলত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত ঝিঙ্গা বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। তবে সারাবছরই ঝিঙ্গার চাষ করা যায়।
চাষাবাদের জন্য হেক্টর প্রতি ৩-৪ কেজি বা শতাংশ প্রতি ১২-১৫ গ্রাম বীজের প্রয়োজন হয়।
জমি নির্বাচন এবং বেড ও মাদা তৈরি
গাছের শিকড় বৃদ্ধির জন্য ঝিঙ্গা চাষের আগে জমি বারবার চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে তৈরী করতে হবে; যেন জমিতে কোন বড় ঢিলা এবং আগাছা না থাকে।
কাঙ্খিত ফলনের জন্য এমন জমি নির্বাচন করতে হবে যা সেচ ও পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোক আছে।
বেড তৈরি…
- বেডের উচ্চতা হবে ১৫-২০ সেমি।
- বেডের প্রস্থ হবে ১.২ মিটার এবং লম্বা জমির দৈঘ্য অনুসারে সুবিধামত নিতে হবে।
- পরপর বেড তৈরি করতে হবে।
- পাশাপাশি দুইটি বেডের মাঝখানে ৬০ সেমি ব্যাসের সেচ ও নিকাশ নালা থাকবে।
- এবং ফসল পরিচর্যার সুবিধার্থে প্রতি দুবেড পর পর ৩০ সেমি প্রশস্ত নালা থাকবে।
মাদা তৈরি ও চারা রোপণ…
- মাদার আকার হবে ব্যাস ৫০ সেমি, গভীর ৫০ সেমি এবং তলদেশ ৫০ সেমি।
- ৬০ সেমি প্রশস্ত সেচ ও নিকাশ নালা সংলগ্ন উভয় বেডের কিনারা হইতে ৬০ সেমি বাদ দিয়ে মাদার কেন্দ্র ধরে ২ মিটার অন্তর অন্তর এক সারিতে মাদা তৈরি করতে হবে।
- প্রতি বেডে এক সারিতে ১৬-১৭ দিন বয়সের চারা লাগাতে হবে।
- চারা রোপণের পর সার প্রয়োগের যে মাত্রা উল্লেখ আছে তা প্রয়োগ করতে হবে।
ঝিঙ্গার ভালো ফলন পেতে অবশ্যই মাচায় চাষ করতে হবে। ঝিঙ্গা মাটিতে চাষ করলে ফলের একদিক বিবর্ণ হয়ে বাজার মূল্য কমে যায়, ফলে পচন ধরে এবং প্রাকৃতিক পরাগায়ন কম হয় এজন্য ফলনও কমে যায়।
সার প্রয়োগ (শতাংশ প্রতি)
ঝিঙার চাষ ভালো হয় দোঁয়াশ মাটিতে। তবে মাটিতে জৈব কার্বনের মাত্রা উচ্চ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এছাড়া গাছের বৃদ্ধি ও ভালো ফলন পেতে প্রতি সারিতে গোবর সার, খোল, সিঙ্গ সুপার ফসফেট প্রভৃতির পাশাপাশি রাসায়নিক সার প্রয়োজনে খুব অল্প পরিমাণে প্রয়োগ করতে হবে।
যেমন …
পরবর্তী পরিচর্যা
গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হলে সেচের প্রয়োজন হয়না। কিন্তু ফেব্রুয়ারির শেষ সময় থেকে মে মাস পর্যন্ত খুব শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ কারণে অনেক সময় বৃষ্টিই থাকে না।
এ সময় ভালো ফলন পেতে ৬-৭ দিন অন্তর নিয়মিত সেচ দিতে হবে। প্রত্যেক সেচের পর হালকা মালচ করে গাছের গোড়ার মাটির চটা ভেঙ্গে দিতে হবে।
এছাড়া…
- আগাছা জমতে দেয়া যাবে না।
- নিয়মিত আগাছ দমন করতে হবে।
- জমিতে সেচ এবং সার প্রয়োগ করার পর জমি থেকে আগাছা বাছাই করতে হবে।
ঝিঙ্গার রোগ ও পোকা এবং এর সমাধানঃ
ঝিঙ্গার অন্যতম শত্রু বিটল পোকা ও ফলের মাছি পোকা। মাছি ফসল নষ্ট করে, এছাড়া গান্ধি পোকা রস চুষে খায়ে ঝিঙ্গা গাছের পাতাকে রস শূণ্য করে ফেলে।
এসব ক্ষতিকারক পোকা-মাকড়ের আক্রমণ থেকে ঝিঙ্গার গাছ ও ফলকে রক্ষা করতে নিয়মিত কীটনাশক পরিমাণমত স্প্রে করতে হবে ।
ঝিঙ্গার পাতা ছিদ্রকারী পোকা
ক্ষুদ্র কীড়া ঝিঙ্গা গাছের পাতার সবুজ অংশ খেয়ে পাতার উপর ছিদ্র করে ফেলে এর ফলে পাতার খাদ্য উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়।
ছিদ্রকারী পোকা দমনে ব্যবহার করুন লরেন্ট ৫এসজি (স্থানীয়ভাবে অনুপ্রবেশযোগ্য স্পর্শক ও পাকস্থলীক্রিয়া গুণসম্পন্ন প্রবাহমান কীটনাশক)।
এর প্রতি কেজিতে ৫০ গ্রাম এমামেকটিন বেনজয়েট বিদ্যমান। প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ শতক জমির জন্য ১০ গ্রাম, একর প্রতি মাত্রা ২০০ গ্রাম, হেক্টর প্রতি মাত্রা ৫০০ গ্রাম।
ফলের মাছি পোকা
স্ত্রী মাছি কচি ঝিঙ্গার ফলের নিচের দিকে ওভিপজিটর ঢুকিয়ে ডিম পাড়ে।
ডিম পাড়ার স্থান থেকে পানির মত তরল পদার্থ বেড়িয়ে আসে যা শুকিয়ে বাদামী রং ধারন করে।
ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের শাস খেতে শুরু করে এবং ফল বিকৃত হয়ে যায় এবং হলুদ হয়ে পঁচে ঝড়ে যায়।
ফলের মাছি পোকা দমনে ব্যবহার করুন টোপাম্যাক ৭০ ডব্লিউ জি (প্রতি কেজিতে ৭০০ গ্রাম ইমিডাক্লোপ্রিড)।
প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ শতক জমির জন্য ২ গ্রাম, একর প্রতি মাত্রা ৪০ গ্রাম, হেক্টর প্রতি মাত্রা ১০০ গ্রাম।
ডাউনি মিলডীউ
বয়স্ক পাতায় এ রোগ প্রথম দেখা যায়। আক্রান্ত পাতার গায়ে সাদা বা হলদে থেকে বাদামী রঙের তালির মত দাগ দেখা যায়।
এদাগ ধীরে ধীরে অন্যান্য পাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
ডাউনি মিলডীউ দমনে অত্যন্ত কার্যকরী ছত্রাকনাশক হলো ট্রয় ৬৩.৫ এসসি (প্রতি লিটারে এজোক্সিস্ট্রবিন ১১০ গ্রাম + সিপ্রোকোনাজল ৪০ গ্রাম + টেবুকোনাজল ১২৫ গ্রাম বিদ্যমান)।
১০ লিটার পানিতে ৫ শতক জমির জন্য ১০ মিলি, একর প্রতি ২০০ মিলি, হেক্টর প্রতি মাত্রা ৫০০ মিলি।
ফসল সংগ্রহ ও পরিপক্কতা
ঝিঙ্গার গাছ লাগানোর ৫০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ করা যায়।
ভক্ষণযোগ্য পরিপক্কতা সনাক্তকরণ…
• ফল পরাগায়নের ৮-১০ দিন পর সংগ্রহের উপযোগী হয়।
• ফল মসৃণ ও উজ্জল দেখাবে।
শেষ কথা
ছাদে বা বাড়ির আঙ্গিনায় ঝিঙ্গা চাষ করে যেমন পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাজারে বিক্রয় করে অর্থ উপার্জন করা সম্ভব।
এছাড়া ভালো জাত উর্বর মাটিতে উত্তমরুপে চাষ করতে পারলে হেক্টর প্রতি ১০-১৫ টন (শতাংশ প্রতি ৪০-৬০ কেজি ) ফলন পাওয়া সম্ভব।
সুত্র: লেখাটির বিভিন্ন তথ্য কৃষি তথ্য সার্ভিস ও অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
আরো পড়ুন …
- জেনে নিন চিচিঙ্গা চাষের সহজ পদ্ধতি
- ধুন্দল চাষ ও রোগ-বালাই দমন পদ্ধতি জেনে নিন
- যেভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁপে চাষ করবেন
- চাল কুমড়া চাষের আধুনিক পদ্ধতি
- তরমুজ চাষের সহজ পদ্ধতি ও সঠিক পরিচর্যা
- কোন মাসে কী ধরনের শাক-সবজি ও ফল চাষ করবেন
**চাষাবাদ ও কৃষি সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, খবর পড়তে আজই জয়েন করুন আমাদের অফিসিয়াল ফেসবুক গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ” বীজ ঘর ( কৃষি কথা )” অথবা টেলিগ্রাম চ্যানেল ”বীজ ঘর ( কৃষি কথা )’‘ এ।